প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প আগামী ৫ নভেম্বরের নির্বাচনে পুনরায় মুখোমুখি হবার পথে আছেন। জনমত জরীপে দেখা যাচ্ছে, রিপাবলিকান দলের অন্যান্য প্রার্থীদের চেয়ে ট্রাম্প অনেক এগিয়ে আছেন। ডেমোক্র্যাট দলের মনোনয়নের জন্য বাইডেনের বিপক্ষে কোন উল্লেখযোগ্য প্রার্থী নেই।
তবে, ট্রাম্পকে ঘিরে আইনগত জটিলতা এবং দুজন প্রার্থীর বয়স নিয়ে নানা প্রশ্ন মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। ট্রাম্পকে ৯১টি অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে অন্তত একটি ফৌজদারি মামলার কার্যক্রম এ বছর শুরু হবে বলে ধারনা করা হচ্ছে।
আর স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত প্রশ্ন ৭৭-বছর বয়সী ট্রাম্প এবং ৮১-বছর বয়সী বাইডেন, দু’জনকে নিয়েই আছে।
দু’জনের একজনকে স্বাস্থ্য, আইনগত বা অন্য যে কোন কারণে যদি প্রতিযোগিতা থেকে সরে যেতে হয়, তাহলে কী হবে? উত্তর নির্ভর করবে, কখন সেরকম পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে, তার উপর।
প্রার্থী যদি জানুয়ারী ১৫ এবং দলীয় কনভেনশনের মাঝের সময়টাতে সরে দাঁড়ান
বিভিন্ন রাজ্য ১৫ জানুয়ারী থেকে ৪ জুন পর্যন্ত প্রাইমারি নির্বাচন আর ককাস-এর আয়োজন করবে। এই প্রক্রিয়ায় যে দু’জন প্রার্থী সব চেয়ে বেশি ডেলিগেট বা প্রতিনিধি পাবেন, তারা তাদের নিজ দলীয় সম্মেলন বা কনভেনশনে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী মনোনীত হবেন।
রিপাবলিকান দলের জাতীয় কনভেনশন উইসকন্সিন রাজ্যের মিলওয়াউকি শহরে ১৫-১৮ জুনে অনুষ্ঠিত হবে। ডেমোক্র্যাট দলের জাতীয় কনভেনশন ইলিনয় রাজ্যের শিকাগো শহরে ১৯-২২ অগাস্টে অনুষ্ঠিত হবে।
ধারনা করা হচ্ছে, ট্রাম্প এবং বাইডেন দু’জনেই নিজ দলের প্রার্থী মনোনীত হবেন। কিন্তু তাদের কেউ যদি ককাস-প্রাইমারি মৌসুমের শুরু থেকে দলের কনভেনশনের আগে প্রতিযোগিতা থেকে সরে যান, তখন কিছু কিছু রাজ্য মনোনয়ন পত্র দাখিলের শেষ তারিখ এবং প্রাইমারি নির্বাচন প্রক্রিয়ার তারিখ পিছিয়ে দিতে পারে। এর ফলে, আরও প্রার্থী প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবে।
এই মুহূর্তে বাইডেনের যেহেতু উল্লেখযোগ্য কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, তাই ডেমোক্র্যাট দলের ক্ষেত্রে সময় বাড়ানোর সম্ভাবনা বেশি। তাঁর দুই প্রতিদ্বন্দ্বী, কংগ্রেস সদস্য ডিন ফিলিপ্স এবং লেখক মারিয়ান উইলিয়ামসন খুব একটা পরিচিত নাম নন, এবং তাঁরা ইতোমধ্যে কয়েকটি রাজ্যের ব্যালটে নাম লেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
নির্বাচন এবং সরকার বিষয়ে আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউটের গবেষক জন সি ফোরটিয়ার বলছেন, ‘’এখানে প্রাইমারি নির্বাচন প্রক্রিয়ার একটি আভাস অন্তত তারা দেখতে চাইবে।’’
‘’খুব অল্প সময়ের নোটিস পাওয়া যাবে, কিন্তু তাঁরা অন্তত জনগণের সামনে যাবার সুযোগ পাবেন,’’ তিনি ভিওএ-কে বলেন।
কিন্তু, সব নিয়ম-কানুন ঠিক মতো কাজ করলেও, ব্যালট পেপারে নাম বদলের সময় নাও পাওয়া যেতে পারে। প্রাইমারি নির্বাচনে ভোটাররা ভোট দিতে গিয়ে হয়ত মৃত বা শারীরিক অক্ষমতার কারণে অযোগ্য ঘোষিত প্রার্থীর নাম দেখতে পাবেন। কিছু রাজ্যে নির্ধারিত তারিখের আগেই ভোট দেয়া যায়। সেখানে দেখা যেতে পারে, যে প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে গেছেন, তিনি হয়ত কিছু ভোট আগেই পেয়ে গেছেন।
সেক্ষেত্রে, রাজ্যগুলো জরুরি ভিত্তিতে আইন সংশোধন করতে পারে, যাতে ডেলিগেট বা প্রতিনিধিরা কনভেনশনে তাদের ভোট অন্য কাউকে দিতে পারেন। দলের মনোনয়ন পেতে হলে, একজন রিপাবলিকান প্রার্থীকে কনভেনশনে উপস্থিত ২,৪২৯ জন ডেলিগেটের মধ্যে অন্তত ১,২১৫ জনের ভোট পেতে হবে। আর ডেমোক্র্যাট প্রার্থীর প্রয়োজন ৩,৯৩৬ জন প্রতিনিধির মধ্যে ১,৯৬৯ জনের ভোট।
বাইপার্টিজান পলিসি ইন্সটিটিউটের একজন পরিচালক মাইকেল থরনিং বলছেন, ‘’এই মুহূর্তে প্রতিযোগিতায় আছেন, তেমন কেউ নাও হতে পারে।‘’
‘’কনভেনশন এমন কাউকে বাছাই করতে পারে, যাকে তাঁরা দলের সেরা প্রতিনিধি মনে করেন, এবং তাদের মতে সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হবার সম্ভাবনা সব চেয়ে বেশি,’’ তিনি ভিওএ-কে বলেন।
কনভেনশন আর নির্বাচনের দিনের মাঝের সময়টাতে যদি প্রার্থী সরে দাঁড়ান
এই সময়ের মধ্যে প্রার্থী সরে গেলে কী করতে হবে, তা নিয়ে প্রত্যেক দলের নিজস্ব নিয়ম-কানুন আছে। মূলত, তারা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ব্যালট পেপারে প্রার্থীর নাম বদল করবে। কিছু রাজ্যে জরুরি ভিত্তিতে আইনের সংশোধন করতে হতে পারে।
জন সি ফোরটিয়ার বলছেন, ‘’এখানে একটা প্রক্রিয়া আছে, যেখানে গোটা কনভেনশন না, কিন্তু ছোট একটি গ্রুপ, যারা দলের নেতৃত্ব দেন কিন্তু যাদের আমেরিকার মানুষ খুব একটা চেনে না, তাঁরা অন্য কাউকে মনোনয়ন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে।‘’
তিনি বলেন যে, তখন দলগুলোকে সম্ভবত আমেরিকার জনগণকে ব্যাখ্যা দিতে হবে, কেন তাদের মনোনীত নতুন এই প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতা আছে।
যেমন ধরুন, ভাইস প্রেসিডেন্ট কামালা হ্যারিসকে হয়ত ডেমোক্র্যাট দলের টিকেটের প্রধান প্রার্থী হবার জন্য অনুরোধ করা যেতে পারে, কিন্তু সেটার কোন আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই।
‘’এই পর্যায়ে, প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর সহ-প্রার্থী হওয়ার মানে এই না যে, প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন পাওয়ার কোন নিশ্চয়তা আছে,’’ মাইকেল থরনিং বলেন।
এখানেও কিন্তু ঐ সম্ভবনা রয়ে যায় যে, সময়ের অভাবে আগের প্রার্থীর নাম ব্যালট পেপারে রয়ে যেতে পারে, বা তিনি প্রতিযোগিতা থেকে সরে যাবার আগেই কিছু ভোট পেয়ে থাকতে পারেন।
নির্বাচনের দিন আর ইলেকটোরয়াল কলেজের বৈঠকের মাঝে
নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন বা আপত্তির নিষ্পত্তির পর ১৭ ডিসেম্বর প্রতিটি রাজ্যের ইলেকটোর বা নির্বাচকরা মিলিত হবেন প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে (যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন পদ্ধতি অনুযায়ী, প্রতিটি রাজ্যে তার কংগ্রেস সদস্য সংখ্যা অনুপাতে ইলেকটোর থাকেন। যেমন, বড় রাজ্য ক্যালিফোর্নিয়ার আছে ৫৪ জন ইলেকটোর, আর ছোট রাজ্য নর্থ ডাকোটার মাত্র ৩। সব মিলে যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি রাজ্য এবং ডিসট্রিক্ট অফ কলাম্বিয়ার মোট ৫৩৮টি ইলেকটোর আছেন, এবং যে প্রার্থী ২৭০টি ইলেকটোরয়াল কলেজ ভোট পাবেন, তিনি জয়ী ঘোষিত হবেন। তবে প্রথা অনুযায়ী, প্রতিটি রাজ্যের ভোটারদের সরাসরি ভোটে যে প্রার্থী জয়ী হবেন, সেই রাজ্যের সকল ইলেকটোর ঐ প্রার্থীর পক্ষেই ভোট দেন)।
যদি ট্রাম্প বা বাইডেন এই সময়ের মধ্যে মারা যান বা শারীরিক ভাবে দায়িত্ব পালনে অক্ষম হয়ে যান, তাহলে তাঁর নির্বাচিত-ভাইস প্রেসিডেন্ট কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে প্রেসিডেন্ট হয়ে যাবেন না। কারণ, প্রেসিডেন্টের উত্তরাধিকারের প্রক্রিয়া এই পর্যায়ে কার্যকর হয় না।
মৃত বা অক্ষম নির্বাচিত-প্রেসিডেন্টের যায়গায় কে আসবেন, সে সিদ্ধান্ত একই পদ্ধতিতে নেয়া হয়। যে ইলেকটোররা নির্বাচিত-প্রেসিডেন্টের তালিকায় ছিলেন, তাঁরা একজন নতুন প্রার্থী বাছাই করবেন। এখানে কেন্দ্রীয়ভাবে কোন নির্দেশিকা নেই, এবং ইলেকটোররা কীভাবে ভোট দেবেন, সে ব্যাপারে কিছু রাজ্যের নিজস্ব নিয়ম-কানুন আছে।
এখানে, নির্বাচিত-ভাইস প্রেসিডেন্টকে বাছাই করা যৌক্তিক হতে পারে, কিন্তু আইনে সেরকম কোন গ্যারান্টি নেই।
ইলেকটোররা যদি একজন নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে ব্যর্থ হন, তাহলে সংবিধানের ১২তম সংশোধনীর আওতায়, কংগ্রেসের নিম্ন কক্ষ হাউস অফ রেপ্রেসেনটেটিভস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে, আর উচ্চ কক্ষ সেনেট ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে। এই প্রক্রিয়াকে ‘কন্টিনজেন্ট নির্বাচন’ বলা হয়।
সংবিধানের ২০তম সংশোধনী অনুযায়ী, কংগ্রেস যতদিন না নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে নিয়োগ দিচ্ছে, ততদিন নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ চালিয়ে যাবেন।
ইলেকটোরাল কলেজের বৈঠক আর কংগ্রেসের সারটিফিকেশনের মাঝে
ইলেকটোরাল কলেজ বৈঠকে বসবে ১৭ ডিসেম্বর, এবং তাদের দেয়া ভোট কংগ্রেস গণনা করে সত্যায়িত বা সারটিফাই করবে ৬ জানুয়ারী, ২০২৫। এই দুই তারিখের মাঝে যদি কোন প্রার্থী মারা যান বা শারীরিক ভাবে দায়িত্ব পালনে অক্ষম হয়ে যান, তাহলে কী হবে তা স্পষ্ট নয়।
কংগ্রেসের সারটিফিকেশন আর অভিষেকের দিনের মাঝে
সংবিধানের ২০তম সংশোধনী অনুযায়ী, কংগ্রেস নির্বাচনের ফলাফল সত্যায়িত বা সারটিফাই করার পর যদি নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মারা যান বা শারীরিক ভাবে দায়িত্ব পালনে অক্ষম হয়ে যান, তাহলে নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট ২০ জানুয়ারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন।
প্রতিটি পর্যায়ে আইনগত বা রাজনৈতিক সংকটের সম্ভাবনা থাকে, বিশেষ করে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে যদি ২০২০ সালের মতো বিতর্ক সৃষ্টি হয়। যখন সেনেটে ডেমোক্র্যাটদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ক্ষীণ, আর হাউস অফ রেপ্রেসেনটেটিভে রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাও খুবই স্বল্প, তখন কে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হবেন সেটা ঠিক করা খুবই গোলমেলে একটা কাজ হবে, যা আদালত পর্যন্ত টেনে নেয়া হবে।
আর, ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারী ট্রাম্প সমর্থকদের কংগ্রেস ভবন ঘেরাও-এর সময় দেশবাসী যেমনটা দেখল, এবারও ঘটনা রক্তাক্ত পর্যায়ে যেতে পারে।