অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

মার্টিন লুথার কিং: কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার নেতার 'প্রয়োজন আজও ফুরায়নি' 


মার্টিন লুথার কিং মেমোরিয়াল-এর রাতের বেলার একটি দৃশ্য। ডিসেম্বর ২৯, ২০২০।
মার্টিন লুথার কিং মেমোরিয়াল-এর রাতের বেলার একটি দৃশ্য। ডিসেম্বর ২৯, ২০২০।

আজকের বিশ্বে, যেখানে সহিংসতা এবং যুদ্ধ বিগ্রহ মানুষের জীবনকে বিক্ষত করছে, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র’এর প্রয়োজন অনুভব করেন অনেকেই। যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত কিং জুনিয়র ১৯৬০-এর দশকে যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তার প্রভাব সারা বিশ্বে পড়েছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন।

জানুয়ারি মাসের তৃতীয় সোমবার যুক্তরাষ্ট্রে উদযাপিত হয় ড. মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র দিবস। দিনটি তাঁর জন্মদিন ১৫ই জানুযারির কাছাকাছি সময়ে উদযাপন করা হয় । এ বছর তৃতীয় সোমবারই হচ্ছে ১৫ জাানুয়ারি।

যুক্তরাষ্ট্র মার্টিন লুথার কিং কে অনুসরণ করে এগিয়ে গেছে অনেকখানি। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে একটি মাইল ফলক রচিত হয় ২০০৮ সালে যখন কৃষ্ণাঙ্গ সেনেটার ব্যারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। যুক্তরাষ্ট্রের সংসদ কংগ্রেসে কৃষ্ণাঙ্গ সদস্যরা নির্বাচিত হয়েছেন।

এ’প্রসঙ্গেই কথা হচ্ছিল পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অফ বাংলাদেশ’এর পরিচালক এবং বিশ্বব্যাংকের পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের নেতৃস্থানীয় অর্থনীতিবিদ ড. আহমাদ আহসানের সঙ্গে। ড. আহসান অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ একাধিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

১৯৬০ সালের এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র আটলান্টায় বক্তৃতা দিচ্ছেন।
১৯৬০ সালের এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র আটলান্টায় বক্তৃতা দিচ্ছেন।

মানবাধিকারের সংগ্রাম

ড. আহমাদ আহসান ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “নাগরিক অধিকার এবং মানবাধিকারের ক্ষেত্রে ওনার সংগ্রাম এবং ওনার অবদানের জন্য শুধু যুক্তরাষ্ট্র না সারা পৃথিবীর মানুষ ওনার কাছে বিশাল ভাবে ঋণী।

‘’তাঁর একটি স্বীকৃতি হলো উনি শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৬৪ সালে। ওনার নাগরিক অধিকার আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৬৫ সালে আইনে পরিণত হয় যাকে বলা হয় সিভিল রাইটস অ্যাক্ট। সেই অ্যাক্টের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে জাতিগত এবং বর্ণবাদী বৈষম্যের অনেকখানি নিরসন ঘটে।

‘’এ ক্ষেত্রে বলা প্রয়োজন আমরা যারা অভিবাসীরা আছি যুক্তরাষ্ট্রে তারা ওনার কাছে বিশেষ ভাবে ঋণী। আমরা যে আজকে এই যুক্তেরাষ্ট্রে সব ধরণের অধিকার পেয়ে থাকি তা তাঁর এই আন্দোলনের ফসল,” ড. আহসান বলেন।

অ্যালাবামার সেলমায় র‍্যালীতে মার্টিন লুথার কিং। মার্চ ২১, ১৯৬৫।
অ্যালাবামার সেলমায় র‍্যালীতে মার্টিন লুথার কিং। মার্চ ২১, ১৯৬৫।

অহিংস আন্দোলন

মাত্র ৩৯ বছর বয়সে ১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল হত্যা করা হয় যে মার্টিন লুথার কিংকে, তিনি তাঁর ঐ সংক্ষিপ্ত জীবনে সোচ্চার ছিলেন মানুষের অধিকার নিয়ে। তিনি যে কেবল গির্জার নেতা ছিলেন তাই-ই নয় বরঞ্চ তিনি ধর্মীয় আবর্তের বাইরে এসে মানবতার পক্ষে একজন সক্রিয় ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন।

অহিংস আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তিনি বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। বিশেষত ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৬৮ সালে নিহত হবার আগে অবধি তিনি অহিংস অসহযোগিতা আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তি হয়ে এ্ই আমেরিকায় মানুষের ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অনেকখানি অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ১৯৬৩ সালের ২৮ শে আগস্ট ওয়াশিংটনে এক বিশাল মিছিলের নেতৃত্ব দেন। তিনি লিংকন মেমোরিয়েলে দাঁড়িয়ে পরিবেশেন করেন তাঁর শ্রেষ্ঠতম ভাষণ, ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম।‘ কি সে স্বপ্ন ছিল তাঁর?

নাগরিক অধিকারের সমর্থক প্রায় আড়াই লক্ষ লোকের সামনে তিনি মনে করিয়ে দেন যে যদিও ১৮৬৩ সালের ঘোষণায় লক্ষ লক্ষ দাসের মুক্তির কথা বলা হয়েছিল তবুও “১০০ বছর পরে, এখনও নেগ্রোরা মুক্তি পায়নি।”

মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ১৯৬৩ সালের ২৮ অগাস্ট ওয়াশিংটনের লিনকন মেমোরিয়ালে তাঁর বিখ্যাত 'আই হ্যাভ এ ড্রিম' ভাষণটি দিচ্ছেন। (ফাইল ছবি)
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ১৯৬৩ সালের ২৮ অগাস্ট ওয়াশিংটনের লিনকন মেমোরিয়ালে তাঁর বিখ্যাত 'আই হ্যাভ এ ড্রিম' ভাষণটি দিচ্ছেন। (ফাইল ছবি)

‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’

এই ভাষণে যেন কবির মতো কিং কল্পনা করেন এমন এক জগতের, যেখানে মানুষে মানুষে কোন বিভেদ থাকবে না, থাকবে না কোন বর্ণবাদ যেখানে মানুষ একত্রে বসবাস করবে এক শান্তিপূর্ণ পরিবেশে।

‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ এমন এক জোরালো বাক্যাংশ যা বিশ্বব্যাপী মানুষের মনে এমন একটা অনুরণন তৈরি করে যেখানে রয়েছে আশা, একতা ও নাগরিক অধিকার অর্জনের প্রচেষ্টা।

কিং এমন একটি রাষ্ট্রের স্বপ্নের কথা তুলে ধরেন যেখানে গায়ের রং দিয়ে কোন ব্যক্তিকে বিবেচনা করা হবে না, বিবেচনা করা হবে তার চরিত্র দিয়ে।

বর্ণবাদী বিভাজনমুক্ত একটি সমাজের স্বপ্ন দেখেছেন মার্টিন লথার কিং জুনিয়র। তাঁর এই স্বপ্নের একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে বিভাজিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিলুপ্তি যেখানে প্রতিটি শিশু তার বর্ণ নির্বিশেষে মানসম্পন্ন শিক্ষা অর্জন করতে পারবে।

মার্টিন লুথার কিং-র নাতনি ১৫ বছর বয়সী ইয়োলোন্ডা কিং ২৬ অগাস্ট, ২০২৩-এ ওয়াশিংটনে লিনকোন মেমোরিয়ালে ভাষণ দিচ্ছেন।
মার্টিন লুথার কিং-র নাতনি ১৫ বছর বয়সী ইয়োলোন্ডা কিং ২৬ অগাস্ট, ২০২৩-এ ওয়াশিংটনে লিনকোন মেমোরিয়ালে ভাষণ দিচ্ছেন।

গত বছর মার্টিন লুথার কিং-এর সেই কথা, “আই হ্যাভ এ ড্রিম” উচ্চারণের ৬০ তম বার্ষিকীতে তাঁর নাতনি ১৫ বছর বয়সী ইয়োলোন্ডা কিং বলেন, “আজ যদি আমি আমার দাদুর সঙ্গে কথা বলতে পারতাম, আমি বলতাম, আমি দুঃখিত, তোমার কাজ সম্পন্ন করার জন্য এবং তোমার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য আমাদের এখনও করে যেতে হবে।

“আজও আমাদের মধ্যে বর্ণবাদ রয়ে গেছে। দারিদ্র রয়ে গেছে। আর এখনতো আরাধনার স্থানগুলিতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, বিপণী প্রতিষ্ঠানে বন্দুক সহিংসতা শুরু হয়েছে,” ইয়োলোন্ডা কিং বলেন।

বক্সিং চ্যাম্পিয়ন মুহাম্মাদ আলীর (বাঁয়ে) সাথে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, ২৯ মার্চ, ১৯৬৭।
বক্সিং চ্যাম্পিয়ন মুহাম্মাদ আলীর (বাঁয়ে) সাথে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, ২৯ মার্চ, ১৯৬৭।

অধিকার প্রতিষ্ঠা

নানান প্রতিবন্ধকতা সত্বেও মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের অর্জনগুলোর মধ্যে ছিল যুক্তরাষ্ট্রে সিভিল রাইটস অ্যাক্ট ১৯৬৪ বা ১৯৬৪ সালের নাগরিক অধিকার আইন যা সকল ধরণের বৈষম্য – শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা সর্বসাধারণের জন্য ব্যবহৃত কোন স্থানে অথবা চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্যকে বেআইনি ঘোষণা করে।

এই আইন স্বাক্ষরের সময়ে তিনি সেখানে ছিলেন।

তা ছাড়া ১৯৬৫ সালের ভোটাধিকার আইন যা ভোটের ব্যাপারে দক্ষিণের অনেকগুলি অঙ্গরাজ্যে বৈষম্যমুলক ভোট দেয়ার বিষয়টি বাতিল করে দেয়। আমেরিকান সিভিল ওয়ারের পর ভোটাধিকার পা্ওয়ার জন্য সাক্ষরতার প্রমাণ দিতে হতো।

পৃথিবী জুড়ে অস্থিরতা

আজও মার্টিন লুথার কিং-এর প্রাসঙ্গিকতা প্রসঙ্গে ড. আহসান বলেন, “আজকে ২০২৪ সালের শুরুতে আমি ওনার অভাব বিশেষ করে বোধ করছি। দু্‌টিা কারণে। একটা হলো সারা পৃথিবী জুড়ে আজকে যে অস্থিরতা এবং অশান্তি বিরাজ করছে, মারাত্মক যুদ্ধ চলছে যেখানে সাধারণ বেসামরিক মানুষ, মহিলা, শিশু প্রচন্ড আক্রমণের মুখে ইউক্রেনে এবং বিশেষ করে গাজায় এবং অনেক ভাবে হতাহত হচ্ছে।

‘’উনি সারাজীবন ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে যোদ্ধা এবং শান্তির পথে সংগ্রামি। সেই কারণে তিনি আজকে জীবিত থাকলে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করতেন, আন্দোলন করতেন। ওয়াশিংটনে গাজা যুদ্ধের বিরুদ্ধে যে মিছিল হয়েছে আমার বিশ্বাস তিনি থাকলে এতে যোগ দিতেন,” ড. আহসান বলেন।

স্ত্রী কোরেটার সাথে মার্টিন লুথার কিং। মার্চ ২২, ১৯৫৬।
স্ত্রী কোরেটার সাথে মার্টিন লুথার কিং। মার্চ ২২, ১৯৫৬।

যুক্তরাষ্ট্রে চরম আর্থিক বৈষম্য

তিনি বলেন, “দ্বিতীয় যে কারণে আমি তাঁর অভাব বোধ করি তা হলো গত কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রে চরম ভাবে আর্থিক বৈষম্য বেড়ে গেছে। আজকে স্বল্প আয়ের ২০ ভাগ মানুষের যে সম্পদ বা ধন রয়েছে তার আটগুণ বেশি সম্পদ রয়েছে সর্ব উচ্চবিত্ত এক ভাগ মানুষের।

‘’শুধু অর্থের ক্ষেত্রে নয়, নিম্নবিত্ত আমেরিকানরা শিক্ষা-স্বাস্থ্যে অনেক ভাবে বঞ্চিত। উনি আজকে জীবিত থাকলে এরে বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকতেন আন্দোলন করতেন। ওনার জীবনের শেষ দিকে ওনার আন্দোলনের মোড় সেদিকেই গিয়েছিল যে অর্থনৈতিক বৈষম্য কি করে দূর করা যায়,’’ তিনি বলেন।

ড. আহসান স্মরণ করিয়ে দেন, “মার্টিন লুথার কিং যে ভাবে ১৯৬৪ সালে নাগরিক অধিকার আইন এবং ১৯৬৫ সালে সকলের জন্য ভোটাধিকার আইন পাশে সক্রিয় সহায়তা করেছেন তা আমেরিকার ইতিহাসে বড় রকমের পরিবর্তন নিয়ে আসে । তাঁর লেখা এবং ভাষণগুলি তাঁর বিশ্বাসের কাছাকাছি আমাদের নিয়ে আসে।”

হত্যা নিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব

কিং-এর হত্যা নিয়েও নানান রকমের তত্ব রয়েছে। অনেকেই মনে করেন যে তার হত্যাকান্ডটি একক একজন বন্দুকধারীর কাজ ছিল না । এর পেছনে ষড়যন্ত্র কাজ করেছিল বলে অনেকের সন্দেহ।

যদিও সরকারি বিবরণে বলা হয়েছে যে জেমস আর্ল রে একাই তাঁর হত্যার জন্য দায়ী, কোন কোন সাক্ষ্য প্রমাণে এই তথ্যের ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে। তবে কোন নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে মার্টিন লুথার কিং ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন।

XS
SM
MD
LG