গত গ্রীষ্মে ইউক্রেনের পালটা হামলা প্রতিহত করার পর রাশিয়া শীতকালে যুদ্ধের নতুন পর্বের জন্য তাদের অস্ত্র সম্ভার বাড়াচ্ছে। এর আওতায় তারা ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে তাদের দখল আরও সম্প্রসারিত করতে পারে এবং ইউক্রেনের জরুরি অবকাঠামোর ওপর বড় মাপের আঘাত হানতে পারে।
মনে করা হচ্ছে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আশা করছেন একদিকে জোর সামরিক চাপ, অন্যদিকে পরিবর্তনশীল পশ্চিমা রাজনৈতিক সমীকরণ এবং ইসরাইল-হামাস যুদ্ধের দিকে বিশ্বের দৃষ্টির কারণে, ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন কমবে। প্রায় দুই বছর ধরে রাশিয়া ইউক্রেনের ওপর তাদের দাবি পূরণের লক্ষ্যে যুদ্ধ করছে।
কার্নেগি রাশিয়া ইউরেশিয়া সেন্টারের সিনিয়র ফেলো তাতিয়ানা স্তানোভায়া এক সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে বলেন, রুশ নেতৃত্বের সাথে পশ্চিমের সংঘাত একটা সন্ধিক্ষণে পৌঁছেছে: ইউক্রেনের পালটা হামলা ব্যর্থ হয়েছে, রাশিয়া আগের চাইতে আরো আত্মবিশ্বাসী হয়েছে, আর পশ্চিমা দেশগুলোর ঐক্যে ফাটল ক্রমশ বাড়ছে।
ইউক্রেনের জন্য সাহায্যের প্যাকেজ যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে আটকে আছে। সেখানে রিপাবলিকানরা বলছেন, ইউক্রেনকে আরো টাকা দেয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্র এবং মেক্সিকোর সীমান্তে নিরাপত্তার খাতে সাহায্য যোগ করতে হবে। ডেমোক্র্যাটরা এর বিরোধিতা করছেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন গত সপ্তাহে ইউক্রেনের জন্য অতি জরুরি ৫,৪০০ কোটি ডলারের সাহায্য প্যাকেজের বিষয়ে সম্মত হতে ব্যর্থ হয়।
'ইউক্রেনের সেনারা ক্লান্ত'
পশ্চিমা সমর্থন দুর্বল হয়ে আসার এইসব ইংগিতের মধ্যে রাশিয়া ইউক্রেনের সাথে ১০০০ কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ ফ্রন্ট লাইনের কয়েকটি অংশে তাদের সামরিক চাপ বাড়িয়েছে।
কার্নেগি এনডাওমেন্টের সামরিক বিশেষজ্ঞ মাইকেল কফম্যান বলেন, অক্টোবর থেকে রুশ বাহিনী ফ্রন্ট লাইনের কয়েকটি জায়গায় হামলা করার চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, পাঁচ মাসের তীব্র পালটা হামলার পর ইউক্রেনের বাহিনীকে নতুন করে সাজিয়ে যুদ্ধে তাদের কার্যকারিতা প্রমাণ করতে হবে।
‘’ইউক্রেনের সেনারা যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক কিন্তু তারা ক্লান্ত,’’ কফম্যান সাম্প্রতিক এক পডকাস্টে বলেন। ‘’ তারা যুদ্ধে প্রচুর সৈন্য হারিয়েছে।প্রচুর প্রশিক্ষিত, অভিজ্ঞ সৈন্য হারিয়েছে।’’
উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় কুপিয়ান্সক শহরে রাশিয়া চাপ অব্যাহত রেখেছে। এটি কৌশলগত ভাবে জরুরি রেল কেন্দ্র যা মস্কো যুদ্ধের প্রথম দিকে দখল করেছিল। ইউক্রেনের পালটা হামলায় ২০২২-এর সেপ্টেম্বরে তারা সেটির নিয়ন্ত্রণ হারায়।
রুশ বাহিনী ঐ এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ কোনো জায়গা দখল করতে পারেনি। তবে ইউক্রেনকে ঐ শহর রক্ষা করার জন্য যথেষ্ট সংখ্যক সেনা মোতায়েন রাখতে হচ্ছে।’’
অক্টোবরের শুরুতে রুশ বাহিনী আভদিভকায় অভিযান চালায়। শহরটি যে ডনেটস্ক অঞ্চলে, মস্কো সমর্থিত বিদ্রোহীরা ২০১৪ সাল তার নিয়ন্ত্রণ দখল করে এবং ২০২২ সালে রাশিয়া বেআইনি ভাবে ইউক্রেনের আরও তিনটি অঞ্চলসহ ডনেটস্ক নিজ প্রশাসনের অন্তর্ভুক্ত করে।
ইউক্রেন আভদিভকায় কংক্রিটের প্রতিরক্ষা এবং পাতাল টানেলসহ বিভিন্নরকম প্রতিরোধ ব্যবস্থা নির্মাণ করেছে। এর মাধ্যমে তারা রাশিয়ার তীব্র আক্রমণ প্রতিহত করেছে। প্রচুর ক্ষতি সত্ত্বেও রাশিয়ার বাহিনী ধীরে ধীরে এগিয়েছে এবং আভদিভকা ঘিরে ফেলে ইউক্রেনের সরবরাহ লাইন থেকে শহরটিকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছে।
বাখমুতের মত আভদিভকা
এই যুদ্ধ দুই পক্ষের জন্য একটা কঠিন অবস্থা তৈরি করেছে। এটিকে বাখমুতের যুদ্ধের সাথে তুলনা করা হয় যেখানে দীর্ঘতম এবং তীব্রতম যুদ্ধ হয়েছিল। মে মাসে রাশিয়া বাখমুত দখল করে।
ক্রেমলিন এবং রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় স্পষ্ট কোনো পরিকল্পনার কথা না বললেও কিছু রুশ ব্লগার বলছেন, মস্কো ইউক্রেনের গভীরে বড় মাপের সেনা অভিযান চালাতে পারে।
অন্যরা বলছেন, এমন বড় অভিযান চালানোর শক্তি রুশ বাহিনীর নেই, কারণ সেজন্য অনেক বেশি সৈন্য এবং অস্ত্র প্রয়োজন হবে। যুদ্ধের শুরুতে রাশিয়া কিয়েভ এবং উত্তর-পূর্বের কিছু শহর দখল করতে চেষ্টা করে যেমন ব্যর্থ হয়েছিল, একইরকম ঝুঁকি এখানেও রয়েছে।
ঐ ব্যর্থ হামলায় রুশ সাঁজোয়া বহর কিয়েভ অভিমুখী মহাসড়কে সহজেই ইউক্রেনের ড্রোন এবং আর্টিলারি হামলার শিকার হয়। ঐ বিপর্যয় ক্রেমলিনকে ফ্রন্ট লাইনে আত্মরক্ষামূলক কৌশল নিতে বাধ্য করে।
পুতিন যুদ্ধে তার সাফল্য প্রমাণ করতে ভীষণ ভাবে আগ্রহী কারণ আগামী মার্চে তিনি পুননির্বাচিত হবার চেষ্টা করছেন। গত সপ্তাহে তিনি বলেন ইউক্রেনে রাশিয়ার ৬,১৭,০০০ সৈন্য আছে। সমর বিষয়ক ব্লগাররা মনে করেন ইউক্রেনের গভীরে অভিযান চালানোর জন্য এই পরিমাণ সেনা যথেষ্ট নয়। প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেন্সকি বলেছেন, তার সেনা সংখ্যা ৬,০০,০০।
পশ্চিমা পর্যবেক্ষকরা জোর দিয়ে বলছেন, মস্কোর সম্ভাব্য বড় অভিযান ঠেকাতে ইউক্রেনকে শক্ত প্রতিরোধ তৈরি করতে হবে, যেমনটা রাশিয়া করেছে।
মায়াক ইন্টেলিজেন্সের প্রধান এবং লন্ডনে রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউটের সিনিয়র অ্যাসোসিয়েট ফেলো মার্ক গালিওত্তি বলেন, ইউক্রেনের খুব কমসংখ্যক রিসার্ভ সৈন্য আছে।
রাশিয়া ক্ষেপণাস্ত্র মজুত করছে
সাম্প্রতিক এক পডকাস্টে তিনি বলেন, মস্কো যদি ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেদ করতে পারে, তাহলে রুশ বাহিনী যোগাযোগ ব্যবস্থা, সরবরাহ লাইন এবং সরবরাহ ঘাঁটির ব্যাপক ক্ষতি করতে পারে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রুশ বাহিনী আকাশ এবং সমুদ্র থেকে নিক্ষেপযোগ্য দূর পাল্লার ক্রুজ মিসাইলের ব্যবহার কমিয়েছে। অনেকে মনে করছেন, এর অর্থ হলো মস্কো শীতকালে ইউক্রেনের বিদ্যুৎ গ্রিড এবং অন্যান্য জরুরি অবকাঠামোতে আঘাত করার জন্য ঐসব অস্ত্র মজুত করছে। কারণ শীতকালে ঐসব অবকাঠামোর ওপর বেশি চাপ থাকে।
একই সাথে রাশিয়া কিয়েভ এবং অন্যান্য অঞ্চলে ইরানের তৈরি শাহেদ ড্রোনের হামলা বাড়িয়েছে, যাতে ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ফুরিয়ে যায়।
গত শীতে রাশিয়া ইউক্রেনের বিদ্যুৎ গ্রিডের ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়, যার ফলে দীর্ঘ সময় ব্ল্যাক আউট হয়েছে। কিন্তু তারা বিদ্যুৎ নেটওয়ার্ক ধ্বংস করতে পারেনি। ইউক্রেনের কর্মকর্তারা বলছেন, রুশ হামলার কারণে এবারের শীত আরও কঠিন হতে পারে।
পশ্চিমা দেশগুলো কিয়েভ এবং অন্যান্য জরুরি এলাকা রক্ষা করতে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিলেও বিভিন্ন দিক থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হলে তা সামাল দেয়া ইউক্রেনের জন্য কঠিন হবে।
ইউক্রেনের মিত্ররা আমেরিকার তৈরি কিছু এফ-সিক্সটিন ফাইটার জেট দেবার অঙ্গীকার করেছে। ইউক্রেনের পাইলটরা রোমানিয়াতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। তবে কবে নাগাদ ঐসব বিমান পৌঁছাবে, তা স্পষ্ট নয়।
রাশিয়া অস্ত্র তৈরি বাড়িয়েছে
নেটোর সেক্রেটারি জেনারেল ইয়েন্স স্টলটেনবার্গ বলেছেন, এফ-সিক্সটিন ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষাকে জোরদার করবে, কিন্তু শুধু একটি ব্যবস্থা দিয়ে যুদ্ধের বড় কোনো পরিবর্তন আসবে না।
ওয়াশিংটন এবং ব্রাসেলস যখন ইউক্রেনে সামরিক সাহায্য দেয়া অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, তখন রাশিয়া তাদের ক্ষেপণাস্ত্র, ট্যাংক এবং অন্যান্য অস্ত্র তৈরি বাড়িয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, মস্কো উত্তর কোরিয়ার সাথে সেপ্টেম্বরে এক চুক্তির আওতায় গোলাবারুদ পেতে শুরু করেছে।
রুশ সামরিক বাহিনী তাদের বেশ কিছু দুর্বলতা এবং ঘাটতি কাটিয়ে উঠেছে যা যুদ্ধের প্রথম দিকে তাদের জন্য প্রবল সমস্যা সৃষ্টি করেছিল। তারা নতুন নতুন অস্ত্র এবং কৌশল নিয়েছে যা ইউক্রেনের পালটা হামলা ঠেকাতে সাহায্য করেছে। দক্ষিণে ব্যাপক এলাকায় মাইনফিল্ডের ব্যবহার এবং অন্যান্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিয়েভের হামলাকে কার্যত নস্যাৎ করে দেয়।
ডাম্ব থেকে স্মার্ট বোমা
আরেকটি কৌশল রুশ বাহিনীকে প্রচুর সাহায্য করেছে, তা হলো সোভিয়েট আমলে নির্মিত ডাম্ব বোমায় ছোট পাখা আর জিপিএস যোগ দিয়ে তাকে স্মার্ট, গ্লাইড বোমায় পরিণত করা। এর ফলে, দূর থেকে লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁতভাবে আঘাত করা সম্ভব হয়েছে।
যুদ্ধের শুরুতে ইউক্রেনের ড্রোন শক্তি বেশি থাকলেও রুশ বাহিনী পরে তাদের সমকক্ষ হয়ে ওঠে, এমনকি স্বল্প পাল্লার ছোট ড্রোনের ক্ষেত্রে তারা ইউক্রেনীয়দের ছাড়িয়ে যায়। মস্কোর হাতে এখন এত বেশি ড্রোন যে, তারা এগুলো এক একজন সৈন্যর বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে।
কফম্যান বলেন, ইউক্রেন ড্রোনের ব্যবহার আগে শুরু করলেও রাশিয়ার কাছে এখন বেশি ড্রোন আছে এবং তারা সুবিধাজনক অবস্থানে আছে।
তিনি আরও বলেন, "২০২৪ সালে রাশিয়া গোলা-বারুদের দিক থেকে এগিয়ে থাকবে, সেই সাথে ড্রোন নির্মাণ, সম্ভবত দূর পাল্লার ড্রোন এবং ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের ক্ষেত্রেও।"
কফম্যান বলেন, "পশ্চিমা দেশগুলো যদি মনে করে যুদ্ধে এক ধরনের স্থিতাবস্থা চলে এসেছে, যার ফলে ইউক্রেনের জন্য সাহায্য কমিয়ে দেয়া যায়, তাহলে রাশিয়ার সুবিধা কয়েকগুণ বেড়ে যাবে, কারণ রাশিয়া অচলাবস্থা মেনে নিবে না।’’