অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

বাংলাদেশে বিরোধী রাজনীতিকদের না পেয়ে আত্মীয়স্বজনদের আটক-হয়রানির অভিযোগ


প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশের ঢাকা সেনানিবাসের পোস্ট অফিস এলাকা থেকে ৫ নভেম্বর (রবিবার) রাতে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদুকে আটক করেছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তার সঙ্গে ভাগ্নে ব্যবসায়ী হাসনাত আশরাফ রবিনকেও আটক করে ডিবি পুলিশ। এ ঘটনায় শামসুজ্জামান দুদুর ভাই অ্যাডভোকেট ওয়াহিদুজ্জামান ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলছিলেন, "রবিবার ( ৫ নভেম্বর) রাতে ডিবি পুলিশের একটি দল ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় আমাদের বোনের বাড়ি থেকে শামসুজ্জামান দুদুর সঙ্গে ভাগ্নে হাসনাত আশরাফ রবিনকেও আটক করে।"

মঙ্গলবার (৭ নভেম্বর) ভয়েস অফ আমেরিকার সঙ্গে আলাপকালে অ্যাডভোকেট ওয়াহিদুজ্জামান উল্লেখ করেন, "হাসনাত আশরাফ কোনও রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। আমরা যতটুকু জেনেছি, গাড়ি ভাংচুর মামলার আসামি দেখিয়ে তাকে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়েছে নিউমার্কেট থানার পুলিশ।"

বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলন করতে গিয়ে গত ২৯ অক্টোবর থেকে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে। তৃতীয় দফায় ৮ ও ৯ নভেম্বর সড়ক, রেল ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচি চলছে। এসব কর্মসূচির মধ্যেই বিএনপিসহ কিছু বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বাসায় পুলিশের অভিযান ও পরিবারের সদস্যদের আটক করার অভিযোগ সামনে এসেছে। বিগত কয়েকদিন ধরে ঢাকার সংবাদপত্রগুলোও তা প্রকাশ করেছে।

তবে সরকার দাবি করছে, নিরীহ কোনও ব্যক্তি নয়, বরং সরাসরি যাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে, তাদেরকেই আটক করা হচ্ছে।

যা বলছেন স্বজনরা

বিএনপির নেতাদের গ্রেফতার করতে গিয়ে না পেয়ে তাদের পরিবারকে আটক করা হয়েছে- এমন পাঁচটি পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে ভয়েস অফ আমেরিকার এই প্রতিবেদক। পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যাদেরকে আটক করা হয়েছে তারা কেউ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয়। কেউবা ব্যবসা করেন বা আবার কেউ এখনও পড়াশোনা করছেন।

  • ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও নেতাকর্মীদের মধ্যে সংর্ঘের পর ওই রাতে দলটির ভাইস চেয়ার‍ম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টুর গুলশানের বাসায় অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এই সময় তাকে বাসায় না পেয়ে ছোট ছেলে ব্যবসায়ী তাজওয়ার এম আউয়ালকে আটক করে পুলিশ এবং গুলশান থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। যদিও পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
  • গত ২৯ অক্টোবর বিএনপির ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির সদস্য ইশরাক হোসেনকে গ্রেফতার করতে ঢাকার গুলশানের বাসায় অভিযান চালায় ডিবি পুলিশ। পরে তাকে বাসায় না পেয়ে ছোট ভাই ইশফাক হোসেনকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়। ওইদিন তাকে নাশকতার অভিযোগে পল্টন থানায় দায়ের করা মামলায় ৫ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। রিমান্ড শেষে তাকে কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হয়।
  • নারায়ণগঞ্জ জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন সালু। গত ২ নভেম্বর পুলিশ সালাউদ্দিনকে না পেয়ে তার শ্বশুর ব্যবসায়ী ইসহাক ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করেছে। এরপর গত ৬ নভেম্বর ইসহাক ভূঁইয়ার জন্য ওষুধ নিয়ে নারায়ণগঞ্জ কারাগারে গেলে তার দুই ব্যবসায়ী ছেলে নয়ন ভূঁইয়া ও সুমন ভূঁইয়াকে গাড়ি ভাঙচুরের মামলার অজ্ঞাত আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বর্তমানে তারা তিনজনই কারাগারে আছেন।

মঙ্গলবার (৭ নভেম্বর) সালাউদ্দিন সালু ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "আমরা শ্বশুর ও শ্যালকরা কেউ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয়। তারা কোনও দিন মিটিং-মিছিলে যায়নি। পুলিশ আমাকে না পেয়ে প্রথমে আমার শ্বশুরকে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রেফতার করে। আর গতকাল শ্বশুরকে ওষুধ দেওয়া জন্য নারায়ণগঞ্জ কারাগারে গেলে ডিবি পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতার করে গাড়ি ভাংচুরের মামলার আসামি হিসেবে দেখিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়।"

  • গত ৩১ অক্টোবর বাংলাদেশের কি‌শোরগঞ্জ পৌর বিএনপির সভাপতি আমিনুল ইসলাম আশফাককে গ্রেপ্তার করতে তার জেলা শহরের বাসায় অভিযান চালায় পুলিশ। বাসায় না পেয়ে তার দুই শিক্ষার্থী ছেলে শহীদুল ইসলাম অনিক ও মাকসুদুল ইসলাম আবিরকে আটক করে পুলিশ। পরে তাদেরকে হামলা ও ভাঙচুরের মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কি‌শোরগঞ্জ কারাগা‌রে পাঠানো হয়।

আমিনুল ইসলাম আশফাক ভয়েস অফ আমেরিকা বলেন, "আমি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও আমার এই দুই জমজ ছেলে, তারা কোনও ধরণের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয়। তারা লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে। পুলিশ আমাকে ধরতে গিয়ে না পেয়ে... ছেলেদের ধরে নিয়ে যায়। তারা এখনও কারাগারে আছে।"

  • বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপির) ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সদস্য সচিব মো. আমানউল্লাহ আমানকে ধরতে গত ৩০ অক্টোবর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার রাজধানী ঢাকার মিরপুরের বাসায় অভিযান চালায়। তাকে না পেয়ে বড় ভাই শহীদুল্লাহ্ মুছুল্লীকে আটক করে নিয়ে যায়।

মঙ্গলবার (৭ নভেম্বর) শহীদুল্লাহ্ মুছুল্লীর কলেজ পড়ুয়া ছেলে ওমর সাইফুল্লাহ ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানান, "তার বাবা ব্যবসা করেন। ডিবি পুলিশ গত ৩০ অক্টোবর রাতে তাদের বাসায় অভিযান চালায়। তার চাচাকে না পেয়ে বাবাকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। এরপর তাকে ৭ দিনের রিমান্ডে রাখা হয়।"

বিএনপির নেতারা যা বলছেন

২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর থেকে বিগত ৪ বছর ধরে আন্দোলন করে আসছে জাতীয়বাদী দল (বিএনপি)। আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে আন্দোলনের ধরনে কিছুটা পরিবর্তন আনে দলটি। এই সময় তারা সারাদেশে পদযাত্রা, বিভাগীয় সমাবেশ করে। এসব কর্মসূচির আগে দলীয় নেতাদের গ্রেফতার ও তাদের বাড়িতে হামলার অভিযোগ করে আসছিলো এতদিন বিএনপি।

কিন্তু গত ২৮ আক্টোবর ঢাকায় দলটির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের পর বিএনপির পক্ষ থেকে নতুন একটি অভিযোগ আসে। সেটি হলো, ২৮ অক্টোবরের পর বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় বিএনপির নেতাদের গ্রেফতারের লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযানে গিয়ে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের না পেয়ে তাদের পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনদের আটক করছে।

বিএনপির পক্ষ অভিযোগ করা হয়, অত্যন্ত ২৫ থেকে ৩০টি পরিবারের অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের আটক করেছে পুলিশ।

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী

এ প্রসঙ্গে বিষয়ে ভয়েস অফ আমেরিকার সঙ্গে কথা বলেন বাংলাদেশ জাতীয়বাদী দল-বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ। তার ভাষ্য, "বিএনপি ও সমমনা বিরোধী দলগুলো গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন করছে। সেই আন্দোলনকে দুর্বল ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে বিএনপির নেতাদের গণহারে গ্রেফতার করছে। শুধু তাই নয়, দেশের বিভিন্ন জেলায় বিএনপির নেতাদের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে রাজনীতির সঙ্গে নয়, এমন পরিবারের সদস্যদের গ্রেফতার করছে।"

কেন অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের গ্রেফতার করা হচ্ছে-- এর কারণ সম্পর্কে অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, "এই সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়, তাদের কোনও ম্যান্ডেট নেই। যার কারণে জনগণের কাছে তাদেরকে জবাবদিহি করতে হয় না। যার ফলে, সরকার অনাচার ও দমনমূলক পন্থা অবলম্বন করছে।"

বিএনপির মিডিয়া সেলের অন্যতম সদস্য শায়রুল কবির খান ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "নেতাদের না পেয়ে তাদের পরিবারের অন্য কোনও সদস্যকে নিয়ে যাওয়া কি উচিত?" তিনি উল্লেখ করেন, "এ ধরনের পরিস্থিতিতে প্রতিটি পরিবার অনেক বড় উদ্বেগের মধ্যে দিয়ে দিন পার করছে।"

সরকার কী বলছে

বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল
বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল

মঙ্গলবার (৭ নভেম্বর) সন্ধ্যায় বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ভয়েস অফ আমেরিকাকে পরিবারের সদস্যদের আটক প্রসঙ্গে বলেন, "কোনও নিরীহ, নিরপরাধ ব্যক্তিকে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার করছে না। যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও ওয়ারেন্ট রয়েছে তাদেরকে গ্রেফতার করা হচ্ছে।"

২৮ অক্টোবরের প্রেক্ষিতে গ্রেফতার প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, "গত ২৮ অক্টোবর প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা ও পুলিশ হাসপাতালে আগুন দিয়েছে এবং পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা করেছে, সেটার ভিডিও দেখেই গ্রেফতার করা হচ্ছে। আপনারা নিশ্চিত থাকেন কোনও নিরীহ, নিরপরাধ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না।"

XS
SM
MD
LG