অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

নিখোঁজ আদিবাসীদের ‘অন্ধকার পরিণতি’


কাপ্তাই, বাংলাদেশ
কাপ্তাই, বাংলাদেশ

কল্পনা চাকমা নিখোঁজ হলেন সেই ১৯৯৬ সালে। এত বছরে কেউ তার খোঁজ তো দিতে পারলেনই না; বরং মামলা চালাতে চালাতে ‘ক্লান্ত’ তার ভাই কালিন্দী চাকমা। মাইকেল চাকমার ঘটনাটি আরও তরতাজা। ২০১৯ সালের। দুটি ক্ষেত্রেই একই ধরনের অভিযোগ-প্রশাসনের অসহযোগিতা। আদিবাসী গোষ্ঠীর অধিকার রক্ষা বিষয়ক সংগঠন কাপেং ফাউন্ডেশন বলছে, আদিবাসীরা এভাবে ‘গুম’ হওয়ার পাশাপাশি ‘নিরাপত্তাহীনতার’ কারণে ‘নিরুদ্দেশও’ হয়ে যান। মানুষগুলো কোথায় যায়, কীভাবে থাকে তার আর তথ্য মেলে না।

কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা ভয়েস অফ আমেরিকার কাছে দাবি করেন, ‘‘কুকি-চিনদের নিয়ে ঝামেলা শুরু হওয়ার পর থেকে গত কয়েক মাসে প্রায় তিন শতাধিক আদিবাসী চট্টগ্রাম থেকে নিরুদ্দেশ হয়েছেন। পরিবারগুলোর লিখিত কোনো তথ্য নেই। এরা অনেকে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেছেন।’’

অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির দাবি, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে ১১৩টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে এবং এসব ঘটনায় ১ হাজার ৩৯২ জন মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন। পাহাড়ের প্রথম রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত সংগঠনটি বলছে, এসব ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা বিচার পাননি।

সংগঠনটির ‘Recent Incidents on Enforced Disappearance, Extra-judicial Killing and Arbitrary Arrest in CHT’-প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, মাইকেল চাকমা নিখোঁজের আগে এবং পরে (২০১৮-২০১৯) কমপক্ষে ৫০০ আদিবাসী মানবাধিকার কর্মী নিজেদের জীবন রক্ষায় এবং গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে থেকেছেন।

বাংলাদেশে কেউ গুম কিংবা নিখোঁজ হলে প্রশাসনের বিরুদ্ধে ‘অসহযোগিতার’ অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, ‘‘আদিবাসীদের ক্ষেত্রে অবস্থা আরও নাজুক। কেউ নিখোঁজ হলে প্রশাসন শুরুতে কোনো গুরুত্বই দেয় না।’’

কল্পনা চাকমা কোথায় গেলেন

পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন কল্পনা চাকমা। ১৯৯৬ সালের ১১ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগের রাতে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার লাল্যাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে ‘অপহৃত’ হন তিনি। সেই রাতে কী হয়েছিল সেটি ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানিয়েছেন তার ভাই কালিন্দী চাকমা। রাঙামাটি থেকে মুঠোফোনে বলেন, ‘‘সেদিন রাতে আর্মিরা আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে। কল্পনা, আমার ছোটভাই এবং আমাকে তারা নিয়ে যায়। সবাই আর্মির গেঞ্জি পরা ছিল। তিনজনকে আমরা চিনতে পারি। তাদের নাম পুলিশকে বলেছি। কিছুদূর যাওয়ার পর ওরা বলছিল গুলি কর, গুলি কর। সামনে একটি বিলের মতো জায়গা ছিল। প্রাণ বাঁচাতে আমার ভাই এবং আমি লাফ দেই। দুজনে পালিয়ে আসলেও কল্পনা রক্ষা পায়নি। ওকে নিয়ে যায়।’’

‘‘পরদিন আমি টিএনও’র অফিসে গিয়ে লিখিত অভিযোগ করি। সেখান থেকে আমাকে থানায় পাঠানো হয়। সারাদিন আমাকে থানায় রেখে রাতে ছাড়া হয়।’’

কল্পনা চাকমার প্রসঙ্গ আসলে কেউ কেউ বলে থাকেন, তিনি ভারতের এক যুবককে বিয়ে করে নিজেই নিরুদ্দেশ হয়েছেন। এই দাবিকে সম্পূর্ণ মিথ্যা বলছেন কালিন্দী, ‘‘আমার বোনকে রাতে আর্মি নিয়ে গেল। আমি আর আমার ভাই পালিয়ে আসলাম। সেখান থেকে আমার বোনকে কে কোথায় বিয়ে দিয়েছে? আর্মি কি আমার বোনকে বিয়ে দিয়েছে? যদি দিয়ে থাকে, তাহলে আমার কাছে ফিরিয়ে দিক। আমার বোনকে চাই। আমার বোনকে ফিরিয়ে আনা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।’’

কল্পনার এভাবে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় শুরুতে পুলিশ গুরুত্ব দেয়নি বলে অভিযোগ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রংয়ের। তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, ‘‘১৯৯৬ সালে কল্পনা চাকমা নিখোঁজ হয়ে গেল। এখনো কোনো খবর নাই। মামলা চলছে। পুলিশ শুরুতে ঘটনাটি পাত্তাই দিতে চায়নি।’’

প্রশাসনের আচরণের কথা উল্লেখ করে সঞ্জীব বলেন ‘‘জাতিগত, ভাষাগত এবং ধর্মীয় এই সংখ্যালঘুরা গুম হলে পুলিশকে জানালে কোনো আন্তরিকতা দেখা যায় না। কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয় না। প্রশাসন থেকে বলা হয়, সে ভারতে চলে গেছে! অথবা অন্য কোথাও আছে। ফিরে আসবে!’’

‘‘একজন নাগরিক যখন হারায়, তখন তাকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এটি রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। কিন্তু আদিবাসীরা যখন নিখোঁজ থাকে, তখন রাষ্ট্র উদাসীন থাকে। এটা হলো অসহায়ত্বের ফিলিংস, নিরাপত্তাহীনতার ফিলিংস এবং দেশান্তরের ফিলিংস। একটি দেশ কতখানি সভ্য সেটি বোঝা যায় তার সংখ্যালঘু মানুষের অবস্থা দেখে। এই তুলনায় আমাদের দেশটা ভালো নেই।’’

মামলার সর্বশেষ অবস্থা

কল্পনা চাকমার মামলার সর্বশেষ অবস্থা জানতে যোগাযোগ করা হয় তার আইনজীবী রাজীব চাকমার সঙ্গে। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘‘কোর্ট থেকে চারটি নির্দেশনা ছিল। ভিকটিম কল্পনা চাকমাকে উদ্ধারে সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো, মামলার সাক্ষী এবং সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ পূর্বক জবানবন্দি ১৬১ ধারা (ফৌজদারি) অনুযায়ী লিপিবদ্ধ করা এবং অভিযুক্তদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা, সর্বোপরি ঘটনার প্রকৃত তথ্য এবং সঠিক রহস্য উদঘাটন করা। এই তদন্তের আদেশ প্রাপ্ত হয়ে রাঙামাটি জেলার পুলিশ সুপার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনা সত্য কিন্তু এর সঙ্গে কারা জড়িত সে বিষয়ে কোনো সুরাহা পুলিশ করতে পারেনি।’’

সিনিয়র আইনজীবী রাজীব চাকমা জানান, এই তদন্ত প্রতিবেদনের উপরে কল্পনা চাকমার ভাই কালিন্দী চাকমা নারাজি দরখাস্ত দেন। এই আবেদনের অধিকতর শুনানি হবে আসন্ন অক্টোবরের ২২ তারিখ।

রাজীবের দাবি, ‘‘কল্পনা চাকমার ভাই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। এর সঙ্গে কে কে জড়িত তাদের সবাইকে তিনি চেনেন। নির্দিষ্ট করে সবার নাম তিনি বলেছেন। কিন্তু পুলিশ তাদেরকে খুঁজে পাচ্ছে না! কোর্ট অভিযুক্তদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে বক্তব্য নিতে আদেশ দিয়েছিল। কিন্তু পুলিশ সেটি করেনি।’’

রাজীব চাকমা বলেন, ‘‘আদিবাসীরা নিখোঁজ হলে রাষ্ট্র বিমাতাসুলভ আচরণ করে। কল্পনা চাকমার ক্ষেত্রে অন্তত আমরা সেটিই দেখছি।’’

মাইকেল চাকমার কী হলো

পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) মাইকেল চাকমা ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ থেকে নিখোঁজ হন। অঞ্চলটির বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেছেন, তিনি আদিবাসীদের ভূমির অধিকারে সবসময় সোচ্চার ছিলেন।

ওই সময় গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে ইউপিডিএফের সহযোগী সংগঠন গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সভাপতি অংগ্য মারমা, শ্রমজীবী ফ্রন্টের (ইউডব্লিউডিএফ) সভাপতি সচিব চাকমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি বিপুল চাকমা ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি নিরূপা চাকমা বলেন, ‘‘সাংগঠনিক কাজ শেষে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হওয়ার পর থেকেই ইউপিডিএফের অন্যতম সংগঠক মাইকেল চাকমা ‘নিখোঁজ’ রয়েছেন। এরপর থেকে তার কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।’’

বিবৃতিতে নেতারা বলেন, ‘‘পাহাড়িদের ঐতিহ্যবাহী উৎসব বৈসাবি (বৈসুক-সাংগ্রাই-বিঝু) ও রানা প্লাজা ধ্বংসযজ্ঞের বার্ষিকী উপলক্ষে কর্মসূচি গ্রহণের জন্য মাইকেল চাকমা শ্রমিক এলাকায় সাংগঠনিক সফরে যান। কাঁচপুর এলাকায় সাংগঠনিক কাজ শেষে গত ৯ এপ্রিল বিকালে ঢাকায় কর্মসূচি বাস্তবায়ন পর্যালোচনা সভায় যোগদানের জন্য রওনা হন। এরপর থেকে তার খোঁজ মিলছে না। তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটিও বন্ধ রয়েছে। ’’

এই ধরনের ঘটনায় প্রশাসনের উদাসীনতার কথা উল্লেখ করে মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, ‘‘আদিবাসী এবং সমতল-যেখানেই গুম হোক না কেন প্রশাসন যথাযথ গুরুত্ব দেয় না। সবক্ষেত্রে আবার মামলাও নেওয়া হয় না। দুএকটি ক্ষেত্রে মামলা হলেও সেগুলো পেন্ডিং থাকে। মাইকেল চাকমা এবং নারী নেত্রী কল্পনা চাকমার খোঁজ এখনো কেউ দিতে পারেনি। পরিবার বলছে তাদের গুম করা হয়েছে। এটি উদাসীনতা ছাড়া আর কিছু নয়।’’

নিখোঁজের পর মৃত্যু

কল্পনা এবং মাইকেল চাকমা জীবিত না মৃত-সে বিষয়ে কোনো খোঁজ না মিললেও নিখোঁজের পর কয়েক জন আদিবাসীর মরদেহ পাওয়ার খবর এসেছে গণমাধ্যমে। তাদের একজন জেএসএসের চিফ কালেক্টর জ্ঞান শংকর চাকমা।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের ১৪ মার্চ জ্ঞান শঙ্কর চাকমা নিখোঁজ হন। পরে জানা যায় তাকে র‌্যাব ধরে নিয়ে গেছে। কিন্তু কোর্টে হাজির না করে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত তাকে হেফাজতে রাখে বাহিনীটি। এরপর ৪ এপ্রিল তার মৃত্যুর খবর আসে স্থানীয় গণমাধ্যমে। পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ তার মৃত্যু হয়েছে।

প্রতিবেদনে মদন চাকমা নামে আরেক জনের কথা বলা হয়েছে। জ্ঞান শঙ্কর চাকমাকে ধরার পর র‌্যাব থেকে তার স্ত্রীকে ক্যাম্পে ডেকে টাকার বিনিময়ে ছাড়িয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয় বলে প্রতিবেদনে দাবী করা হয়। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, জ্ঞানের স্ত্রীর সঙ্গে সেদিন মদন চাকমাও ছিলেন। সেখান থেকে মদন চাকমার আর কোনো খোঁজ মেলেনি। র‌্যাবও তাকে গ্রেপ্তার কিংবা আটকের কথা স্বীকার করেনি।

২০১৯ সালের ২০ মার্চ বরুন চাকমা নামের স্থানীয় আরেক নেতা নিখোঁজ হন। মোটরসাইকেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফিরে আসেননি তিনি। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বরুন নিখোঁজ হওয়ার কয়েক দিন পরও তার ফোন সচল ছিল। পরিবারের শঙ্কা, তাকে অপহরণের পর আটকে রেখেছে নিরাপত্তা বাহিনী।

XS
SM
MD
LG