অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

ডেঙ্গুতে কাতর ঢাকা মহানগর, হাসপাতালে শয্যা সংকট


ডেঙ্গুতে কাতর ঢাকা মহানগর, হাসপাতালে শয্যা সংকট।
ডেঙ্গুতে কাতর ঢাকা মহানগর, হাসপাতালে শয্যা সংকট।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ফুটপাতে বসে পুরোনো কাপড় সেলাই করে ভাতের যোগান নিশ্চিত করেন সায়েদাবাদের রাবেয়া বেগম। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ জীবনে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে তার পরিবারে এসেছে ডেঙ্গু জ্বর।

দুই শিশু-সন্তান রাব্বী ও হাসান ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে ভর্তি করেন মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। সুস্থ হয়ে গেছে বলে তাদের হাসপাতাল ছাড়ার ছাড়পত্র দেন চিকিৎসক। বাসায় নেয়ার পর আবার জ্বর আসে তাদের। ফের নিয়ে আসেন মুগদা হাসপাতালে। ঠাঁই হয়েছে হাসপাতালের মেঝেতে। তাদের জন্য কোনো শয্যা পাননি তিনি। হাসপাতালের মেঝেতে এক বিছানায় দুই ছেলেসহ তিনি কোনো রকমে দিন-রাত পর করছেন।

রাবেয়া বেগম জানান, হাসপাতাল থেকে বাসায় নেয়ার পর, আবার জ্বর আসে ছেলেদের। একই সঙ্গে সারা শরীরে ব্যথায় কাতরাতে থাকে তারা। রাব্বীর বয়স চার বছর তিন মাস এবং হাসানের বয়স ১৯ মাস। দুই ছেলেকে নিয়ে আবার হাসপাতালে এসে মেঝেতে এক বেড নিয়ে ভোগান্তির অন্ত নেই তার।

ক্ষুব্ধ রাবেয়া বলেন, “দুই ছেলের জন্য আলাদা বেড চেয়েছি বার বার। এক বেডে তিনজন কীভাবে থাকা সম্ভব? ওয়ার্ড বয়রা খুব খারাপ ব্যবহার করেছে। বলছে এক বেডে থাকতে পারলে থাকেন, না হলে চলে যান। তাই বাধ্য হয়ে এক বেডে দুই ছেলে নিয়ে তিনজনে মিলে থাকছি।”

একই সঙ্গে চিকিৎসা নিয়েও অভিযোগ রয়েছে রাবেয়ার। তিনি বলেন, “চিকিৎসকের কথায় একবার বাড়ি ফিরে গিয়েছি, আবার হাসপাতালে আসতে বাধ্য হয়েছি। দুই ছেলের জ্বর সারছে না। সঙ্গে সারা শরীরে ব্যথা। ছেলেরা বসতেও পারছে না। ডাক্তার ও নার্সরা বলছেন, সারবে। কিন্তু ছেলেদের কষ্ট তো সইতে পারছি না।”

এমন উদাহারণ আরো আছে; হাসপাতাল থেকে সুস্থতার ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি ফিরে, আবার আসতে হচ্ছে হাসপাতালে। এ তথ্য জানিয়েছেন অনেক রোগীর স্বজন। কারো কারো অভিযোগ, চিকিৎসা শেষ না করেই তড়িঘড়ি করে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে।

এমন অভিযোগ করেন জুরাইন থেকে ২১ মাস বয়সী ছেলেকে নিয়ে আসা রিনা আকতার। ছেলে রায়হানের ডেঙ্গু পরীক্ষার ফল পজেটিভ হলে, মুগদা হাসপাতালে ভর্তি করেন ১৬ জুলাই। ২১ জুলাই চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরেও নানা সমস্যা হচ্ছিলো। অবস্থার অবনতি হলে ২৫ জুলাই আবার হাসপাতালে এলে, চিকিৎসকেরা ভর্তি করতে পরামর্শ দেন। তারও ঠাঁই হয়েছে মেঝেতে।

এ বিষয়ে মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপতালের পরিচালক নিয়াতুজ্জামান জানান, “কমপ্লিকেটেড রোগী বা আগে আক্রান্ত হয়েছে এমন রোগী; অথবা অন‌্য রোগে আক্রান্ত যেমন;উচ্চ রক্তচাপ, লিভার, কিডনি, ক‌্যান্সার; তাদের ক্ষেত্রে জটিলতা একটু বেশি।”

তিনি বলেন, “করোনার ক্ষেত্রে যেমন সুস্থ হওয়ার পর জটিলতা ছিলো, এবার ডেঙ্গুর ক্ষেত্রেও কিছুটা তেমন পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে।” নিয়াতুজ্জামান বলেন, “ডেঙ্গুতে শতভাগ সেরে উঠা যায়। কিন্তু যারা দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের স্বাভাবিক সুস্থতা ফিরে আসতে কিছুটা দেরি হয়।এবার আমরা এমন কিছু কিছু জটিলতা দেখতে পাচ্ছি।”

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, “ডেঙ্গুর মতো রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে চিকিৎসক ও রোগী দুই পক্ষেরই দায় রয়েছে। চিকিৎসা শেষে রোগীকে কী কী করতে হবে, তাও চিকিৎসকদের রোগী বা স্বজনদের বলে দিতে হবে। ডেঙ্গু আক্রান্তদের প্রধান শর্ত হচ্ছে শরীরে তরল পদার্থের ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। রোগী যদি বাড়ি ফিরে যায়, এর মানে এই নয় যে, রোগীর অবস্থা সম্পুর্ণ ভালো, তবে, আরো খারাপ হবে, তাও ঠিক নয়। রোগীকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে।”

তিনি আরো বলেন, “কিছু রোগী মনে করেন ডাক্তারেরা ম্যাজিকের মতো তাদের ভালো করে দেবেন। এটা হয় না। রোগীকে চিকিৎসক তিনটি নির্দেশিকা দেবেন; জীবনযাপন পদ্ধতি, খাবার ও ওষুধ। রোগীদের অধিকাংশই মনে করে চিকিৎসা কেবলমাত্র ওষুধ দিয়েই করা হয়। মূলত ওষুধ তিনটি স্তরের একটি। বাকিগুলো রোগী মেনে না চলার কারণে বারবার হাসপাতালে আসতে হয়।”

রাজধানী ঢাকার সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালের সাধারণ সমস্যা বেড সংকট। মগবাজারের ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী আলামিন পরীক্ষার রেজাল্ট পেয়েছেন ২৪ জুলাই। বেশ কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে বেড পাননি। কমিউনিটি হাসপাতালে সিরিয়াল দিয়ে বেড পান ২৬ জুলাই। এ সময়ের মধ্যে বাসায় থেকে চিকিৎসা নিলেও অবস্থার অবনতি হয়।

তিনি বলেন, “শারীরিক কষ্ট অসহ্য। পেট ফুলে থাকছে আর ব্যথা করছে। ভেতরে খুব অস্বস্তি হচ্ছে। এটা বোঝানোর মতো না।”

স্বল্প আয়ের মানুষের ভরসাস্থল সরকারি হাসপাতাল। তবে অধিকাংশ রোগীই বেড পাচ্ছেন না। কোনো রকমে মেঝেতে থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। ২/৩ দিন পর কেউ হয়তো বেড পাচ্ছে। তবে বেসরকারি হাসপাতালের চিত্র ভিন্ন। সিরিয়াল দিয়ে যেতে হচ্ছে। তারপর সেই অনুযায়ী বেড পেলে হাসপাতালে আসা।

ঢাকা কমিউনিটি ক্লিনিকের সিনিয়র স্টাফ নার্স রেজাউল করিম বলেন, “প্রতিদিন ডেঙ্গু রোগীদের বেডের জন্য অপেক্ষার তালিকা বড় হচ্ছে। সেই অনুযায়ী কেউ একদিন, কেউ দুই পরে বেড পান।”

ঢাকার সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হচ্ছেন মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। সেখানেও বেড সংকট প্রকট।হাসপাতালের পরিচালক নিয়াতুজ্জামান এ প্রসঙ্গে বলেন, “এখানে চারটি ওয়ার্ড ডেঙ্গুর জন্য ডেডিকেটেড। এ ছাড়া বেশ কিছু চিকিৎসক ও নার্স আছেন, যারা ডেঙ্গুর জন্য ডেডিকেটেড। আর সব চিকিৎসকই, যাদের অধিদপ্তর থেকে পদায়িত করা হয়েছে এবং হাসপাতালের নিজস্ব চিকিৎসক ও নার্সরা ডেঙ্গু ওয়ার্ডে কাজ করছেন। এ ছাড়া মিড লেভেলের ডাক্তাররা প্রতিটি ওয়ার্ডে সার্বক্ষণিক সেবা দিচ্ছেন।”

এদিকে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রবিবারের ব্রিফিংয়ে বলা হয়েছে, জুন মাসের তুলনায় জুলাই মাসে বাংলাদেশে ৭ গুণ বেশি ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। অধিদপ্তরের পরিচালক (এমআইএস) অধ্যাপক ডা. মো. শাহাদাত হোসেন জানান, জুন মাসে সর্বমোট ডেঙ্গু রোগী ছিলো ৫ হাজার ৫৬ জন। ১ জুলাই থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে ৩৮ হাজার ৪২৯ জন। তিনি আরো জানান, এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি। পুরুষ ডেঙ্গু রোগী ৬৪ শতাংশ, আর নারী ৩৬ শতাংশ। এ ছাড়া চলতি বছর ৩০ জুলাই পর্যন্ত আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ছিলো ৪৯ হাজার ১৩৮ জন।

XS
SM
MD
LG