বাংলাদেশে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি।বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় এর প্রভাব অনেক বেশি। প্রতিদিন নতুন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী আসছে হাসপাতালগুলোতে। ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। পাশাপাশি বাড়ছে মৃত্যু-সংখ্যা। এমন পরিস্থিতিতে, কয়েকদিন ধরে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিধনে দুই সিটি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছে; আর, জরিমানা করে দায় সারছে তারা। এমন অভিযোগ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এডিস মশার প্রজনন মৌসুমে মশার প্রজনন বন্ধ করার জন্য কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই এবং এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসের জন্যও তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। এ কারণে রোগ নিয়ন্ত্রণে সুফল মিলছে না; দিন দিন বাড়ছে শনাক্ত-হার; বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলেছেন, “ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সারা বছর কার্যকর উদ্যোগ না নেয়ায় এমন ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। মশা নিধন ও ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকার এখনো কার্যকর কোনো নীতিমালা তৈরি করতে পারেনি। তাই সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভায় মশা নিধন কর্মকাণ্ড অকার্যকর হয়ে পড়েছে।কোথাও প্রশিক্ষিত জনবল নেই। তাই জরিমানা করে ও লোক দেখানো কিছু কাজ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হবে।”
এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করার পর, সেখানে আবার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে। লার্ভা শনাক্ত করতে দুই সিটিতে কোনো গবেষণাগার নেই। নেই কোনো কীটতত্ত্ববিদ। এ কারণে ডেঙ্গু রোধে কোনো কার্যক্রম ফলপ্রসূ হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, দুই সিটি কর্পোরেশন এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় দাবি করছে, সর্বোচ্চ চেষ্টার মধ্যেও প্রতিনিয়ত বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী এবং মৃত্যু-সংখ্যা।
কীটতত্ববিদ ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, “ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সারা বছর কার্যকর উদ্যোগ না নেয়ায় এমন ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সারা দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ যখন কম থাকে, তখনই কাজ শুরু করা উচিত।”
তিনি বলেন, “মৌসুমের আগে যেসব জায়গায় মশার উপদ্রব বেশি থাকে, সেখানকার মশা সংগ্রহ করে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা দরকার। যাতে, মৌসুমের শুরুতে এডিস মশা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। এজন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া দরকার।এ ধরনের উদ্যোগ কারো নেই।”
ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, “ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে জরিমানা করার পদ্ধতি বিভিন্ন দেশে থাকলেও, বাংলাদেশে এ পদ্ধতিতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। জরিমানা করে কোনো লাভ হবে না। যেভাবে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা দরকার, সে অনুযায়ী কাজ করছে না রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশন। ফলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।”
তিনি আরো বলেন, “ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি যেসব নির্দেশনা দিচ্ছে, তা অবৈজ্ঞানিক ও ভুল। এ কারণে এসব নির্দেশনা ও কার্যক্রম কোনো কাজে আসছে না। এ ছাড়া দুই সিটিতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দক্ষ জনবল নেই। মনগড়া ও উল্টাপাল্টা পরামর্শ নিয়ে তারা কাজ করছে। এতে কোনো সুফল বয়ে আনবে না। মশা মারতে তারা ফগিং ব্যবহার করছে; অথচ এতে মশা মরে না।”
ডেঙ্গু সংক্রমণ কেন নিয়ন্ত্রণে আসছে না, জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. লেলিন চৌধুরী বলেন, “এখানে বেশ কয়েকটি বিষয় রয়েছে। আমাদের সিটি কর্পোরেশনগুলো যে ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করে তার একটি প্রধান অংশ হচ্ছে প্রদর্শনবাদিতা। অর্থাৎ, তারা যতটা দেখায়, ততটা কার্যকর কাজ তারা করে না।”
তিনি বলেন, “সিটি কর্পোরেশনগুলো কিছু কাজ করলেও, তাদের পক্ষে একা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এর সঙ্গে সাধারণ মানুষ এবং জনপ্রতিনিধিদের যুক্ত করতে হবে। তাহলেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসবে।”
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, “মশা নিধন ও ডেঙ্গু প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কীটতত্ত্ব বিষয়ক কারিগরি দক্ষতা নেই। বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি; তার পরও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখছি না।”
তিনি বলেন, “সিটি কর্পোরেশনের প্রতিটি জোনে পর্যাপ্ত কীটতত্ত্ববিদ ও সহকারী কীটতত্ত্ববিদ প্রয়োজন। উত্তর সিটিতে একজন কীটতত্ত্ববিদকে ডেপুটেশনে আনা হয়েছে। দক্ষিণ সিটিতে একজনও কীটতত্ত্ববিদ নেই। পাশাপাশি এ বিষয়ে গবেষণার জন্য ল্যাবরেটরি দরকার। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয় দরকার।”
ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, “বিশেষজ্ঞ ও কীটতত্ত্ববিদ-এর পরামর্শ মেনে এবং তাদের নেতৃত্বে ডেঙ্গু মোকাবেলা করতে হবে। এখনো তেমন কোনো নীতিমালা তৈরি করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। তাই সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার মশা নিধন কর্মকাণ্ড অকার্যকর হয়ে পড়েছে।”
“কোথাও প্রশিক্ষিত জনবল নেই; তাই জরিমানা করে, লোক দেখানো কিছু কাজ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হবে;” বলেন ডা. বে-নজির আহমেদ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, “ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঠেকাতে বিজ্ঞান ভিত্তিক প্রক্রিয়ায় এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। এই প্রক্রিয়াতে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জনগণকে সরাসরি যুক্ত করতে হতে হবে।”
উল্লেখ্য, মশা নিয়ন্ত্রণে প্রতি বছর বড় অংকের টাকা ব্যয় করে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে মশা নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি কর্পোরেশন খরচ করেছে ১২৮ কোটি টাকা।