“আমি আসলে চল্লিশের পরে এসেই নিজেকে এক্সপ্লোর করার সুযোগ পেয়েছি। তার আগে আমি আমার সংসার, সন্তান, কাজ নিয়ে এতটাই ব্যস্ত এবং এতটাই আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা ছিলাম যে আমার পক্ষে তখন আলাদা করে নিজের জন্য সময় বের করা, নিজেকে নিয়ে ভাবার অবকাশ হয়নি। যখন আমি চল্লিশ পার করলাম, তখন আমার মধ্যে যে ব্যাপারটা কাজ করলো সেটা হচ্ছে, এখন আমার আর কিছু যায় আসে না। আগে আমি সবসময় মাথায় রাখতাম আমাকে কে কীভাবে দেখছে, কী ভাবছে, আমার ভালো-মন্দকে কীভাবে বিবেচনা করছে, গ্রহণ করছে। এখন আর আমার মধ্যে সে বিষয়টা কাজ করে না। আমি যদি এখন বিদেশে যেয়ে হাফ প্যান্ট পরে একটা ছবিও তুলি, আমার মনে হয় না কে আমাকে কীভাবে জাজ্ করছে সেটা নিয়ে আমি ভাবি। একটা সময় কিন্তু ভাবতাম। আমার মনে হয়, চল্লিশের পরে যেয়ে কনফিডেন্স লেভেলটা অনেক বেড়ে যায়। এটা আমার ক্ষেত্রে হয়েছে। আরেকটা বিষয় হলো, এই সময়টাতে একজন নারী আর্থিকভাবে তাঁর পার্টনারের কারণেই
হোক কিংবা নিজের কারণেই হোক কিছুটা স্টেবল হন। যখন একজন নারী মধ্যবয়সে যেয়ে ফিনানশিয়ালি স্টেবিলিটিটা ফিল করবেন, তিনি অনেক কিছু এক্সপ্লোর করতে পারবেন,”- কথাগুলো ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলছিলেন ফ্রিল্যান্স পরিচালক, অভিনেত্রী ও উদ্যোক্তা নাহিন শফিক। মধ্যবয়সে নারীর বিভিন্ন শারীরিক, মানসিক পর্যায় এবং এ সময়ের ‘সেল্ফ কেয়ার’ বা নিজের যত্ন নিয়ে ভয়েস অফ আমেরিকা-র পক্ষ থেকে কথা বলা হয়েছিল চল্লিশোর্ধ কয়েকজন নারী ও মনোবিদের সঙ্গে।
মধ্যবয়স কী? কেনো প্রয়োজন বাড়তি যত্নের?
একটা সময় ছিলো যখন বলা হতো মেয়েরা কুড়িতেই বুড়ি। যুগ তার নিয়মেই পাল্টেছে। এখন আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত কৈশোর ধরা হয়। মধ্যবয়সের বয়সসীমা হলো চল্লিশ থেকে ষাট বছর অবধি। তবে আজকাল চল্লিশকেই নতুন কুড়ি বলা হচ্ছে – ‘ফর্টি ইজ দ্য নিউ টোয়েন্টি’। বয়স চল্লিশ মানে জীবনের একটি নতুন মাইলফলক ছোঁয়া। এখন নিজেকে সময় দেয়ার দিন। ‘মধ্যবয়সী’ ভেবে নিজেকে নিয়ে হাপিত্যেশ না করে চাইলে প্রেমেও পড়া যায় এ বয়সে। কারণ ২০১৬ সালে করা ইউরোপীয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকদের যৌথ গবেষণার ফল বলছে, মধ্যবয়স এখন ষাট বছরে। মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির ফলাফলকে ধরেই সমীক্ষাটি করা হয়েছিলো। তবে এশিয়ান নারীদের বেলায় এখনও চল্লিশ পরবর্তী সময়কেই মোটামুটিভাবে মধ্যবয়স বলা যায়।
মধ্যবয়সে নিজের জন্য প্রয়োজন হয় একটু অতিরিক্ত যত্নের। এ সময় সুষম খাদ্য, ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম, ত্বকের ও চুলের যত্ন এবং সর্বোপরি মনের যত্ন নেয়া ভীষণ প্রয়োজন। চল্লিশের পর থেকে শরীরে কোলজেনের প্রোডাকশন কমে যেতে শুরু করে। ফলে বলিরেখা, পিগমেন্টেশন শুরু হয়। আবার মেনোপজের সময়ে হরমোনাল পরিবর্তনের ফলে অনেকের মধ্যে অ্যাংজাইটি, ডিপ্রেশন আসে, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি দেখা যায়। মেনোপজের পর অস্টিওআর্থারাইটিস, অস্টিওপোরোসিসের মত রোগ দেখা যায়। মেনোপজ সংক্রান্ত আরো অনেক শারীরিক-মানসিক জটিলতা যেমন – হটফ্ল্যাশ, ভ্যাজাইনাল অ্যাট্রফি ইত্যাদি দেখা যায়। ইস্ট্রোজেন-প্রজেস্টেরন ক্ষরণ কমে যাওয়ায় হরমোনাল ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয় যার ফলে শরীরে ও মনে আসে ব্যাপক পরিবর্তন।
সমস্যাগুলিকে সরিয়ে ভালো থাকুন
উদ্যোক্তা আয়েশা এদিব খানম মনে করেন, কুড়ি থেকে চল্লিশ এই ক’টা বছর পড়াশোনা, সংসার শুরু করা, প্রেগনেন্সি, কেরিয়ার সব মিলিয়ে নারীর একটা বিশাল স্ট্রেসের সময় যায়। তখন নিজের দিকে তাকানোর চাইতেও তার সবচেয়ে বেশি ফোকাস থাকে সংসার, সন্তান বড় করা, তার কেরিয়ার ইত্যাদি। মধ্যবয়সে যখন নারী পৌঁছান ততদিনে তার সন্তানেরা পড়াশোনার একটা পর্যায়ে চলে আসে। তার কেরিয়ারও একটা শেপ-এ চলে আসে। কিন্তু এগুলো করতে গিয়ে বিশেষ করে আমাদের সমাজে একজন নারী দেখতে পান তাঁর জীবনের অনেকটা সময় চলে গেছে, নিজের দিকে তাকানোর সময় পাননি। তিনি বললেন, “হঠাৎ করে একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বোধোদয় হওয়ার মত একটা ফিলিংস হলো। একদিন হঠাৎ পাকা চুলটা চোখে পড়ে। তারপর দেখলাম, রাস্তাঘাটে লোকজন যারা আগে ‘আপা’ বলে এড্রেস করতো তারা ‘আন্টি’ ডাকতে শুরু করল। তখন এ বিষয়গুলো কিন্তু খুব কানে লাগতো। প্রথম দিকে খুব ধাক্কা লাগতো, আমি এত বয়স্ক হয়ে গেছি!”
বাংলাদেশের বাংলা একাডেমির উপ পরিচালক রোকসানা পারভীন স্মৃতির মতে, মধ্যবয়সে কনফিডেন্স লেভেলটা খুব ইম্পর্টেন্ট। তিনি বলেন, “চল্লিশোর্ধ বয়সে এসে আমি কোন এডুকেশন ব্যাকগ্রাউন্ড, চাকরি জীবনে, পারিবারিক জীবনে কোন পরিবেশের ভেতর দিয়ে এসে এই জায়গায় অবস্থান করছি সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি আমার কনফিডেন্স লেভেল খুব স্ট্রং তাই আমার জীবনে জটিলতাগুলো খুব কম। সে কারণে আমাকে কেউ আমি কী করব, কীভাবে চলবো, কী পরবো – এগুলো নিয়ে বললে আগে চিন্তা করি, যে বলছে আসলে সে আমাকে এ কথাগুলো বলতে পারে কিনা। অর্থাৎ তার এডুকেশনাল, তার সামাজিক ব্যাকগ্রাউন্ড, পারিবারিক অবস্থান থেকে সে আমার সমপর্যায়ের কিনা বা আমার চাইতে বেশি কিনা। যেহেতু আমি মানসিকভাবে স্ট্রং এবং কী করছি সেটা বোঝার মত বুদ্ধি এবং যথেষ্ট বিবেচনাবোধ আমার রয়েছে বলে আমি মনে করি তাই এ বিষয়গুলো আমাকে ভাবায় না। যারা নেগেটিভ কথা বলে তারা আসলে আমার সমপর্যায়ের না অর্থাৎ আমি বলব যে তাদের মানসিক গঠনটা ঠিক আমার মতো করে হয়নি। আমি খুব পজিটিভ মাইন্ডের একজন মানুষ, খুব পজেটিভ ভাবে সবকিছু চিন্তা করতে ভালোবাসি। কোনও বিষয় কোনও কথা আমার পছন্দ না হলে সঙ্গে সঙ্গে রিঅ্যাক্ট না করে চেষ্টা করি দুই-তিনবার ভেবে সেখান থেকে পজিটিভ কিছু বের করে আনার।”
নাহিন শফিক মনে করেন, একজন নারী চল্লিশের কোঠায় এসে তাঁর অবস্থান, তাঁর সৌন্দর্য নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন কিনা সেটা আসলে অনেকগুলো বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। তিনি বলেন, “একটা বয়সের পরে আপনার রিংকেলস পড়বে, চামড়াটা একটু লুজ হবে, চুলের গোড়া একটু সাদা দেখা যাবে, এটাই তো স্বাভাবিক। এটা সত্যি যে চল্লিশ পার করার পর আমরা অনেকেই অস্থির হয়ে যাই নিজের ফিটনেস ধরে রাখার জন্য। ফ্যাশন সম্পর্কে সচেতন হওয়ার চেষ্টা করি, অনেক কিছু করার চেষ্টা করি। কিন্তু সেটা আসলে নিজেকে ভালো রাখার জন্যই। নিজেকে সুন্দর রাখতে, গুছিয়ে রাখতে গিয়ে যদি আপনি কিছু চর্চা করেন তবে তা খারাপ না। যে বয়সে, যখন যেটা পরতে ইচ্ছে করুক না কেনো সেটা পরাই উচিত। আমি পোশাক নয় বরং আচরণটা নিয়ে ভাবি যে সেটা কেমন হওয়া উচিৎ। আমার আচরণটা বয়সের সাথে যায় কি যায় না সেটা চিন্তা করার চাইতেও আমি কতটা সহনশীল, আমি কতটা মানবীয় গুণাবলীসম্পন্ন মানুষ হয়ে উঠছি আমার এই মধ্যবয়সে সেটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
ভয়েস অফ আমেরিকা-র সঙ্গে কথা বলেছেন আরো একজন নারী, সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা আলেয়া বেগম। তিনি নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলেন, “চল্লিশের পর থেকে মুড সুইং হয়, এনার্জি লেভেল কমে যায়। যেমন আমি এখন আগের মতো এনার্জিটিক না। আমাকে দেখতে আগের মত লাগছে না, আমি চাইলেই লাইভলি থাকতে পারছি না এই জিনিসগুলো আসলে প্রতিটা মেয়েকে খুব কষ্ট দেয়। তাছাড়া আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এমন যে, আমরা কারো সাথে কেউ দেখা হলে প্রথমেই বলি, ‘আল্লাহ! আপনি এরকম হয়ে গেছেন! আপনি মোটা হয়ে গেছেন! আপনাকে এরকম দেখা যাচ্ছে!’ আমাদের সোসাইটি সারাক্ষণই মনে করিয়ে দিতে থাকে যে আপনি তো আগের মত নাই, আপনি বুড়ো হয়ে গেছেন। আমার কথা হল, বার্ধক্য যখন আসছে তখন একটা টিনএজ মেয়ের এনার্জি, লুকিং কোনটাই আমার থাকবে না। কিন্তু আমার যেটা থাকবে সেটাকে আমার মেইনটেইন করতে হবে। সেভাবে আমার ব্যক্তিত্ব বয়সের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে। কিন্তু আমরা সমাজের বিভিন্ন কথায় কমপ্লেক্স ও সোশ্যাল প্রেসারে ভুগে অনেক সময় মরিয়া হয়ে যাই নিজেকে কতটা ইয়াং দেখানো যায় সেটা নিয়ে। আমি দ্বিতীয় সন্তানের মা হয়েছি চল্লিশ বছর বয়সের পরে। তখন আমার এনার্জি খুবই কম ছিলো। আমি অফিস করতাম, বাচ্চার টেক কেয়ার করতাম। দিনের বেলা বাচ্চা ডে-কেয়ারে থাকতো কিন্তু তার সবকিছু আমাকে রেডি করে ডে-কেয়ারে দিতে হতো। এভাবে কেরিয়ার, সন্তান সামলাতে গিয়ে আমি প্রবল চাপে ভুগি। তখন আমি অফিসে একটা সিনিয়র পোস্টে, কাজের অনেক চাপ আবার এদিকে সন্তানের দেখাশোনা। রাত আটটা-নয়টা পর্যন্ত অফিসে থাকতে হতো। এদিকে কন্যাশিশুর সিকিউরিটির ব্যাপারও আছে। তারপর এলো করোনার সময়। আমার মেয়ের বয়স তখন ছিল মাত্র দুই বছর। ওই সময়ে ডে-কেয়ারও বন্ধ ছিল। বাচ্চাকে রাখব কোথায়, সব মিলিয়ে আমি এত এত ইনসিকিউরিটির মধ্যে এক সময় কেরিয়ারের পিক পয়েন্ট-এ এসে জব-টা ছেড়ে দিই।”
মেনোপজ ও অন্যান্য মনোদৈহিক সমস্যা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফারজানা বেগম মেনোপজ সম্পর্কে বললেন, “মেনোপজটা পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চান্ন বছর বয়সের মধ্যে সাধারণত হয়। এই মেনোপজের প্রক্রিয়াটি হুট করে হবে না। এক বছর পর্যন্ত যদি সাইকেলটা অনিয়মিত থাকে বা পিরিয়ড না হয় তখন তাকে আমরা মেনোপজের ক্রাইটেরিয়া হিসেবে ডিফাইন করি। এটা নারীর জীবনের স্বাভাবিক পরিবর্তন। এটাকে কোনো সমস্যা বা রোগ হিসেবে যদি সমাজ বা পরিবার চিন্তা করলেই ওই নারী মানসিকভাবে, শারীরিকভাবে এবং একইসঙ্গে সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।” তিনি আরো বলেন – “যখন একজন নারীর মেনোপজ হচ্ছে তখন এর কিছু লক্ষণ বা উপসর্গ কিন্তু তাঁর মধ্যে দেখা দেবে। যেমন দিনে তিন/চারবার হট ফ্লাশ হতে পারে অর্থাৎ হঠাৎ করে পুরো শরীরে প্রচন্ড গরম অনুভূত হবে এবং কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি দরদর করে ঘামতে থাকবেন। এ ধরণের উপসর্গ একজন নারীর জন্য অস্বস্তিকর হয়ে উঠতে পারে। হট ফ্লাশের তীব্র খারাপ অনুভূতি থেকে একাকীত্ম, বিষন্নতা, মুড সুইং, খিটখিটে মেজাজ ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। এ পরিস্থিতি আমরা পরিবারের সদস্যরা অনেক সময়ই বুঝে উঠতে পারি না। তাঁর যে সে সময় কিছুটা বিশ্রাম প্রয়োজন, আরামের প্রয়োজন সেটা তাঁর সঙ্গী কিংবা ছেলেমেয়েরা বা পরিবারের অন্য সদস্যরা না বুঝেই বিরক্তি প্রকাশ করেন অথবা বিষয়গুলো সম্পূর্ণ ইগনোর করে নিজেদের চাহিদা পূরণে নারীকে ব্যস্ত রাখেন। পরিবারের সদস্যরা যদি এই মেনোপজের বিষয়টি জানেন, বুঝতে পারেন এবং ইতিবাচকভাবে নেন তাহলে সেই সময়টাতে নারীর প্রতি বিশেষ যত্নবান হতে পারেন। নারীর যদি পরিবারেই এ ধরণের শেয়ারিংয়ের জায়গা থাকে তাহলে তাঁর অতিরিক্ত মানসিক চাপ, বিষন্নতায় ভোগা বা অস্থিরতার যে অনুভূতিগুলো যেগুলোকে আমরা সাইকোলজিকাল সিম্পটম হিসেবে ধরে থাকি সেগুলো আস্তে আস্তে কমে যাবে।”
ফারজানার বিশ্লেষণ, যারা মেনোপজের মধ্য দিয়ে যান সেইসব নারীর অনেকেই ভাবেন যে তাঁদের স্বামী বা পুরুষ সঙ্গীর সঙ্গে সম্পর্কে ভাঙন ধরে যাচ্ছে। সঙ্গীকে নিয়ে ইনসিকিউরিটি তৈরি হয়। বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন এই চিন্তা নারীদের মনে চাপ তৈরি করে। এরফলে অনেকেই অতিরিক্ত সাজগোজ, রঙীন চকচকে পোশাক পরা, অতিরিক্ত ছবি তোলা, সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশি এ্যাকটিভ থাকা ইত্যাদি করেন, যা আসলে শরীরের বয়সের সঙ্গে তাঁর মনের তারুণ্য ধরে রাখার দ্বন্দ। আবার নারীদের একটা অংশ মেনোপজকে ইতিবাচক হিসেবে নেন, বিশেষ করে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে। প্রতিমাসে মেনস্ট্রুশন না হওয়া এবং সন্তান ধারণের ভয় না থাকাকে অনেকেই ঝামেলাহীন, উপভোগ্য জীবন মনে করেন। এই বিষয়গুলো পরিবেশ, প্রকৃতি, সমাজ, সংস্কৃতি ও দেশভেদে নির্ভর করে।
ফারজানা জানালেন, এই বয়সে নারীর আরো কিছু শারীরিক সমস্যা হতে পারে। যেমন ইউরিনারি ডিসফাংশন। অনেক সময় ভ্যাজাইনাল ড্রাইনেস, ইচিং, বার্নিং, সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স বা যৌন সংসর্গের ক্ষেত্রেও একটা নেতিবাচক অনুভূতি তৈরি হয়। এ সমস্যাগুলো থেকে সঙ্গীর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি কিংবা বোঝাপড়ার অভাব হতে পারে। যদি এ বিষয়গুলোকে ঠিকঠাক সামলানো না যায় তাহলে সেখান থেকে একা থাকা, সেপারেশন এমনকি ডিভোর্সের ঘটনাও ঘটতে পারে। মনে রাখা দরকার, পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক সাপোর্টের মাধ্যমে নেতিবাচক প্রভাব থেকে নারী বেরিয়ে আসতে পারেন।
মেনোপজ-এর সময়ে ভালো থাকার উপায়
নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, গোসল করা, আরামদায়ক সুতি কাপড় পরতে হবে। হট ফ্লাশ হলে ঘরে আরামদায়ক ঠান্ডা পরিবেশ, পর্যাপ্ত বাতাস সম্ভব হলে এয়ার কন্ডিশনার-এর নিচে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। অতিরিক্ত মাত্রায় চা-কফি, ধুমপান, অ্যালকোহল গ্রহণ ঠিক নয়। এইসব মুড সুয়িংয়ের পরিমাণ বাড়ায়, ঘুমের সমস্যা তৈরি করে। মেনোপজের পর নারী শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের ঘাটতি দেখা দেয়। তা কমানোর ক্ষেত্রে খাবারের একটি বড় ভূমিকা থাকায় ব্যালেন্সড ডায়েট বা ভারসাম্যপূর্ণ খাবার খেতে হবে। শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের উৎপাদন কমে গেলে হাড়ক্ষয় হতে পারে। যেটাকে অস্টিওপরোসিস বলা হয় যা মেনোপজের বিপদজনক শারীরিক প্রভাব হিসেবে বিবেচিত হয়। অস্টিওপরোসিস এবং অস্টিওআর্থারাইটিসের আরেকটি কারণ হচ্ছে চল্লিশের পর শরীরের বাড়তি ওজন। আমাদের শরীরের পুরো ওজনটাই যেহেতু পায়ের হাড়কে বহন করতে হয় তাই ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি-র ঘাটতি থাকলে হাড়ক্ষয়জনিত সমস্যায় ভুগতে হবে। তাই পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে সাপ্লিমেন্ট হিসেবে ওষুধ সেবন করা যেতে পারে। এছাড়া ইস্ট্রোজেন হরমোনের ঘাটতি খুব বেশি হলে সাপ্লিমেন্ট থেরাপির মাধ্যমে ইস্ট্রোজেনের লেভেল বাড়ানো হয়।
সেল্ফ কেয়ার
সেল্ফ কেয়ার মানে হলো নিজের আত্মিক, মানসিক ও শারীরিক যত্ন নেয়া। নিজের বিষয়গুলোর প্রতি অবগত থাকা। নাহিন শফিকের মতে, আপনি নিজে যদি ভালো না থাকেন তাহলে অন্যকে কোনোদিন ভালো রাখতে পারবেন না। এমনকি আপনার নিজের সন্তানকেও না। নিজেকে ভালো রাখতে গিয়ে যদি মনে হয় যারা আপনাকে জাজ্ করছে, অসম্মান করছে, তাদের সঙ্গে আপনি দূরত্ব বজায় রেখে চলবেন, সেটা আপনি করতে পারেন। ভালো থাকার জন্য এ বিষয়গুলো নিজেকেই কেটেছেঁটে ফেলতে হবে। নাহিন মনে করেন যদি পার্লারে গিয়ে স্কিন কেয়ার করে, মাসাজ করে, হাত-পা, চুলের যত্ন নিয়ে ভালো লাগে, সতেজ লাগে তবে তা করা উচিৎ। যদি মেকআপ করে কনফিডেন্স লেভেল বাড়ে তবে তাই করা উচিত।
আয়েশা এদিব খানম ভালো থাকার জন্য অবসরে প্রচুর বই পড়েন। তিনি জানালেন, বিভিন্ন ধর্মীয় বই, বিভিন্ন ধর্মের তুলনামূলক দর্শন, মানব সভ্যতার ইতিহাস ইত্যাদি বিষয় নিয়ে তিনি পড়াশোনা করতে ভালোবাসেন। বয়সের সঙ্গে এখন সামাজিক মেলামেশা কিছুটা কমিয়েছেন বরং বইয়ের মধ্যেই সময় কাটাতে ভালোবাসেন। দুই মেয়ের সঙ্গে মাঝেমাঝে শপিংয়ে যান। বললেন, “আজকালকার মেয়েদের ফ্যাশন, সাজগোজ এগুলো দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। কে কী পরবে, কিভাবে চলবে সেটার কোনো ঢালাও প্রেসক্রিপশন হয় বলে আমার মনে হয় না। এটা রুচি ও ব্যক্তিত্বের ব্যাপার। কাপড়চোপড়ের বেলায় আমি খুব বেশি প্রাচীনপন্থী হতে পারি না কারণ আমার মেয়েরা আমাকে ঠিক করে দেয় আমি কী পরবো। ওরা ওদের জন্য যে টপস, কুর্তি কেনে আমার জন্যও তাই কেনে।”
রোকসানা পারভীন জিম করেন টানা ১৭ বছর ধরে। জানালেন, তাঁর ছেলের বয়স যখন ২ বছর তখন থেকে জিম করছেন। তিনি বলেন, এটাই তাঁর ভালো থাকার মূল মন্ত্র। নিয়মিত যোগ ব্যায়াম , এরোবিক্স, কার্ডিও এক্সারসাইজগুলো করার সুফল হিসেবে শারীরিক ও মানসিকভাবে অনেকের চাইতে বেশি অ্যাকটিভ থাকতে পারছেন বলে জানালেন। এমনকি হরমোনাল ইমব্যালেন্স হওয়া, হট ফ্লাশ হওয়া, মধ্যবয়সের এ ধরণের সমস্যার মুখোমুখি তিনি এখনও হননি। রোকসানা মনে করেন, প্রত্যেক নারীরই নিয়মিত ব্যায়াম করা উচিত। এছাড়াও রোকসানা ভ্রমণকে সেল্ফ কেয়ারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ মনে করেন। তিনি আরো বললেন, “অফিসে আমি টিম ওয়ার্ক-এর মধ্যে কাজ করতে পছন্দ করি। বাড়িতেও কোন কিছু হলে সেটা মায়ের সঙ্গে আলাপ করি। এমনকি আমার ছেলের সঙ্গেও আলাপ করি। কোনো কিছু চেপে রাখি না। আমি ইচ্ছে করে ছেলের সঙ্গে অনেক কিছুই আলাপ করি, তার মতামত নেই যাতে পরবর্তীতে ও না বলতে পারে যে আমি ওর উপর কোনো মত চাপিয়ে দিয়েছি যেটা আমার মেন্টাল স্ট্রেসের কারণ হবে। সে কারণে আমি বিষয়টা শেয়ার করি।”
আলেয়া বেগম পরিকল্পনা করে কাজ করতে পছন্দ করেন। তিনি জানালেন, “আমি আগে থেকে একটা প্ল্যান করেছিলাম যে চল্লিশের পর থেকে রেগুলার একটা হেলথ চেক আপ করাবো। কারণ এই সময়টা থেকেই মেয়েদের নানান ধরনের শারীরিক সমস্যা হতে পারে। সে কারণে বছরে একবার এ ধরনের চেকআপ করাই। আমি মনে করি সব মেয়েরই এই ধরনের হেলথ চেক আপ করানো উচিত। কারণ অনেক ধরনের সমস্যা শরীরের ঘাপটি মেরে থাকে যেগুলো আমরা আসলে চেক আপ না করালে বুঝতে পারি না।” তিনি মনে করেন এজন্য প্রতিটি নারীরই একটি মেডিকেল ফান্ড তৈরি করে রাখা উচিত যাতে হঠাৎ করে অসুস্থ হলে নিজেই নিজের চিকিৎসা ব্যয় বহন করা যায়।
আলেয়া আরো বললেন, “পারিবারিক বন্ধনের মধ্যে থাকাটা অনেক স্ট্রেস থেকে মুক্তি দেয়। তাই আমি সন্তানদেরও সামাজিকীকরণ করার চেষ্টা করি। মোদ্দা কথা হল, একটা কমিউনিটিতে থাকা। কোথাও না কোথাও নিজেকে ওপেন আপ করা। কমিউনিকেশন বাড়ানো। যে জায়গাগুলোতে ইনসিকিউরিটি আছে সেইগুলোকে সিকিওর্ড করার জন্য কাজ করা। যেমন আমি নিজে কোনো কাজ করলাম কিংবা জমানো টাকা দিয়ে একটা সঞ্চয়পত্র কিনলাম। সেখান থেকে আমি একটা আর্নিং পাবো। সে টাকা দিয়ে হয়তো আমি একটা লিপস্টিক কিনলাম কিন্তু এর ভেতরে একটা আনন্দ আছে। এটা আমাকে একটা মেন্টাল রিওয়ার্ড দেবে।”
মনোবিদ ফারজানা পরামর্শ দিলেন, আমরা অনেক সময়েই দেখা যায়, পঞ্চাশোর্ধ বয়সের একজন নারীর কেরিয়ারটা পড়তির দিকে থাকে। এরকম সময়ে সন্তানদেরও নিজস্ব একটা জগৎ তৈরি হয়ে যায়। তারা তাদের নিজেদের পড়াশোনা, কেরিয়ার ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। স্বামী তার নিজস্ব কাজকর্ম, বিভিন্ন সোশ্যাল ক্লাব, কমিউনিটি নিয়ে ব্যস্ত থাকছেন। এক্ষেত্রে দেখা যায় নারীটি নিজেকে আস্তে আস্তে গুটিয়ে ফেলছেন। সমাজ ও পরিবারে তিনি একা হয়ে যাচ্ছেন, নিজেকে মূল্যহীন ভাবতে শুরু করেছেন। কিন্তু যদি একজন নারী সেল্ফকেয়ারের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেন তাহলে তাঁর আত্মবিশ্বাস বাড়বে। একাকীত্ম, মানসিক চাপ, বিষন্নতার মতো অনেক সমস্যা কেটে যাবে। “একজন সাইকোলজিস্ট হিসেবে আমার পরামর্শ হলো, আমরা অবশ্যই নিজের খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে যত্নশীল হবো। পাশাপাশি ব্যায়ামের দিকে নজর দিতে হবে। দিনে অন্তত ত্রিশ মিনিট যেকোনো ব্যায়াম, মর্নিং বা ইভনিং ওয়াকে বের হওয়া বা যোগ ব্যায়াম করা যেতে পারে। এছাড়া বাগান করা, বই পড়া, মুভি দেখা, ধর্মীয় বই পড়া, প্রার্থনা করা, ইউটিউবে শিক্ষণীয় ভিডিও দেখা, ছোট ছোট কোর্স করা ইত্যাদিও ভালো থাকতে ও অ্যাক্টিভ থাকতে সাহায্য করে। আরেকটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। সেটি হলো আমরা আমাদের পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে যেনো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন না করি। তাহলে একাকীত্বের বোধ কম হবে। পরিবারের সঙ্গে কোয়ালিটি টাইম কাটালে তা মানসিকভাবে প্রফুল্ল করে,” মনোবিদ হিসাবে ফরজানার পরামর্শ।