“ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্-কে আমি আমার বাবার সূত্রেই জেনেছি। তিনি আমার দাদা। বাবার কাছে তাঁর অনেক পারিবারিক গল্প শুনেছি। অনেকেই জানেন, তিনি অনেক বই পড়তে ভালোবাসতেন। তাঁর বিশাল লাইব্রেরি ছিলো। তিনি কাউকে সাধারণত বই ধার দিতেন না। কারণ হিসেবে বলতেন, বই গেলে আর ফেরত আসবে না। একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে এই বই পড়তে গিয়েই তিনি আটকে পড়েছিলেন। তিনি বই পড়ায় এতটাই মগ্ন ছিলেন কখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে, লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে গেছে সেটা টের পাননি। যখন একেবারেই আলো কমে গিয়েছিলো, উঠে লাইট জ্বালাতে গিয়ে লক্ষ্য করেন দরজা বন্ধ। এভাবেই তিনি বই পড়ায় নিমগ্ন থাকতেন। ” ভয়েস অফ আমেরিকা-র সঙ্গে আলাপকালে কথাগুলো বলছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর পৌত্রী, কবি ও সাংবাদিক শান্তা মারিয়া।
১০ জুলাই বহুভাষাবিদ, জ্ঞানতাপস ও গবেষক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর জন্মদিন। ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই তিনি ভারতের চব্বিশ পরগণা জেলার পেয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ভাষা ও ভাষাতত্ত্বে তাঁর অগাধ পান্ডিত্য ছিলো। তাঁকে বলা হতো ‘চলমান অভিধান’। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে তাঁর গবেষণা নিরন্তর। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষার্থীরা আজও তাঁর দেখানো পথ ও মত অনুসরণ করে থাকেন। তিনি ১৯১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলণামূলক ভাষাতত্ত্বে এম.এ ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯১৯ সালে তিনি গবেষণা সহকারী হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ১৯১৯ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত তিনি ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের সহকর্মী হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসেবে কাজ করেন। সেসময় তিনি বাংলা ভাষার ঐতিহাসিক ব্যাকরণ সম্পর্কে অনেকগুলো ভাষণ প্রস্তুত করেন। তাঁর এ সংক্রান্ত প্রথম প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় ১৯২০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের “জার্ণাল অব দি ডিপার্টমেন্ট অব লেটারস”-এ। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পাশাপাশি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯২২ থেকে ১৯২৪ সালে পর্যন্ত আইন বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। এরপর তিনি ফ্রানস-এ পিএইচডি করতে যান। ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করার পর তিনি সর্বশেষ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরে যান।
বহুভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রায় চব্বিশটি ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন। ইংরেজি, ফরাসি, সিংহলি, জার্মান, আরবি, উর্দু, হিন্দু, হিব্রু, গ্রিক, ল্যাটিন, পাঞ্জাবি, মারাঠি, তামিল সহ মোট আঠারোটি ভাষার ওপর তাঁর উল্লেখযোগ্য পান্ডিত্য ছিল। তিনি তাঁর অর্জিত ভাষাতাত্ত্বিক প্রজ্ঞার ব্যবহার শুধু বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি আরবি বর্ণমালা, সংস্কৃত ভাষার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, সুমারিয়ান ভাষা ও উর্দু ভাষা সম্বন্ধে লিখেছেন। ইন্দো-ইউরোপীয় মূলভাষা, পশতু, সিংহালা ইত্যাদি ভাষার ব্যবহার নিয়েও লিখেছেন।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন একাধারে ভাষাবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, গবেষক, আইনজীবী, কবি, সাহিত্যিক, অনুবাদক, লোকবিজ্ঞানী, জ্ঞানতাপস, দার্শনিক ও ভাষাসৈনিক। তবে তাঁর বড় পরিচয়, তিনি ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি। জাতিসত্তা সম্পর্কে তাঁর স্মরণীয় উক্তি, “আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙ্গালী।” ভাষা আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সূচনায় অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে তিনিই প্রথম পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ‘বাংলা’ করার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। দেশভাগের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ফজলুর রহমান আরবি হরফে বাংলা প্রবর্তনের প্রচারণা চালান। ১৯৪৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর করাচিতে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান শিক্ষক সম্মেলনে ফজলুর রহমান ভাষার ইসলামিকরণের স্বার্থে বাংলাকে আরবি লিপিতে লেখার প্রস্তাব করেছিলেন। এর প্রতিক্রিয়ায় মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভাষার জটিলতা বৃদ্ধির আশঙ্কা করে প্রস্তাবটির বিরোধিতা করেন এবং বাংলাকে অপরিবর্তিত অবস্থায় পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রভাষা তথা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। সেসময় তিনি ভাষা সমস্যাকে কেন্দ্র করে অনেকগুলো প্রবন্ধ রচনা করেন। তাঁর এই ভূমিকার ফলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পথ অনেকখানি প্রশস্ত হয়।
বাংলা ভাষার নানা সমস্যা যেমন- উচ্চারণ, বানান, ভাষা সংস্কার, বাঙলা লিপি ও হরফ সংস্কার ইত্যাদি বিষয়েও তিনি অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন যা নানাভাবে বাংলাদেশের জনগণের ভাষা সচেতনতা বাড়িয়েছে। এমনকি তিনিই প্রথম বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার দাবি তোলেন। তাঁর একান্ত চেষ্টা ও উদ্যোগে ১৯৫৫ সালে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়।
ভয়েস অফ আমেরিকা-র সাথে কথা বলেছেন গবেষক, প্রাবন্ধিক অধ্যাপক মনসুর মুসা। তিনি দুই মেয়াদে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন এবং তিনি মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র জীবনীকার। মনসুর মুসা স্মৃতিচারণ করে বলেন, “আমার সৌভাগ্য হয়েছিলো তাঁকে বাংলা একাডেমিতে দেখার। তিনি যখন বাংলা একাডেমিতে অভিধান তৈরির কাজ করছিলেন আমি সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র ছাত্ররা ছিলেন আমাদের সরাসরি শিক্ষক। মাঝে মাঝে আমরা একাডেমিতে গেলে তাঁর সাথে দেখা হতো। ‘তোমার নাম কী? তুমি কার ছাত্র?’ সালাম দিলে জিজ্ঞেস করতেন। ‘তাহলে তো তুমি আমার নাতি ছাত্র!’ স্যারদের নাম বলার পর তিনি বেশ মজা করে বলতেন।” মনসুর মুসা মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পর্কে আরো বলেন, “তাঁর জীবনী লেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো। এরকম একজন মানুষ একবারই জন্মেছিলেন। তাঁর সমকক্ষ কেউ আর আসেননি। তিনি যেভাবে বাংলা ভাষা, বাঙালি সত্তাকে, মুসলিম সত্তাকে দেখেছেন, বৌদ্ধ সভ্যতাকে দেখেছেন ঠিক তেমনি ভাবে আর কেউ এককভাবে দেখেননি।”
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তাঁর ছাত্রদের সঙ্গে বেশ রসিকতাও করতেন। তাঁর ছাত্রদের একজন ছিলেন খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক আলাউদ্দিন আল আজাদ। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন আজাদ একবার একই চিঠি হুবহু কপি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি মেয়েকে পাঠিয়েছিলেন। চিঠি পেয়ে মেয়েরা দল বেঁধে চিঠিসমেত নালিশ নিয়ে গিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৎকালীন প্রধান ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র কাছে। তিনি প্রমাণগুলো খুব নিরীক্ষা করে দেখে আজাদকে ডেকে পাঠিয়ে বলেছিলেন-:ছি, পাঁচটা চিঠি পাঁচ রকম করতে পারলে না! তুমি না গল্প লেখো, এই তোমার কল্পনার দৌড়!” [সূত্র: তিন পয়সার জ্যোছনা, সৈয়দ শামসুল হক]
ভাষাবিজ্ঞানী মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে খুব দায়িত্বশীল ছিলেন। শান্তা মারিয়া তাঁর দাদু সম্পর্কে বলেন, “দাদার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যারা দরিদ্র ছিলেন তাদের লেখাপড়ার খরচ তিনি বহন করতেন। আমার দাদাবাড়িতে প্রচুর আত্মীয়-স্বজন আশ্রয় নিতেন। এমনকি পশ্চিমবঙ্গ থেকে কেউ ঢাকায় এলেও দাদাবাড়িতেই উঠতেন। আত্মীয়-স্বজনের অনেকেই লেখাপড়া, চাকরি-বাকরির খোঁজে ঢাকায় আসতেন এবং এ বাড়িতেই আশ্রয় নিতেন। যে কোনো সভা সেমিনার, বক্তৃতা, স্কুল-কলেজের অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করা হলে দাদা সবসময়ই সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। তিনি পারতপক্ষে মানা করতেন না। অনেকসময় আমার দাদী বলতেন, ‘এতদূরে যাবে…কত দূরে দূরে যাচ্ছ এই বয়সে!’ দাদা বলতেন, ‘ওরা আমাকে ডেকেছে মানে ওরা আমার কাছ থেকে কিছু কথা শুনতে চায়। হয়তো আমার কথা শুনে দু’একজন উপকৃত হবে। তাই একটু কষ্ট হলেও আমি যাবো।’ এই বিষয়টি আমি যখন আমার বাবার কাছ থেকে শুনেছি আমার ভীষণ ভালো লেগেছিল এটাই যে, কেউ যখন তাঁকে আমন্ত্রণ করতো তিনি তখন সেই আন্তরিকতাকে উপেক্ষা করতেন না। তিনি মানুষের উপকারের জন্য জ্ঞানের কথা বলতে চাইতেন। যখনই যেখানে বক্তৃতা দিতেন বাংলা ভাষায় কথা বলতেন, বাংলা ভাষার মাহাত্ম্য তুলে ধরতেন।”
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র যে দিকটি সম্পর্কে কম জানা যায় সেটি হলো তাঁর প্রগতিশীল মনোভাব ও নারীশিক্ষায় অবদান। যদিও তাঁর পারিবারিক সূত্রে জানা যায় যে, তিনি সেসময়ের কঠোর রক্ষণশীল সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে তাঁর দুই মেয়েকে বেশিদূর পড়াতে পারেননি। তবে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যেমন খুব ধার্মিক ছিলেন তেমনি নারীশিক্ষা ও প্রগতিশীলতার পক্ষেও ছিলেন। শান্তা মারিয়া ভয়েস অফ আমেরিকা-কে জানান যে তিনিই প্রথম ঢাকা শহরে নারীদের জামাতের ইমামতি করেন। এর আগে এই উপমহাদেশের নারীরা ঈদের জামাতে অংশ নিতো না। শান্তা মারিয়া বলেন, “বিগত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে যখন সারা তৈফুর সহ প্রগতিশীল নারীরা পৃথক ঈদের জামাত করতে চাইলেন, তখন ইমাম খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। মেয়েরা প্রকাশ্যে নামাজ পড়বে, সেটার ইমামতি কেউ করতে চাইছিলো না। সেই প্রতিক্রিয়াশীল সমাজে আমার দাদা খুব সাহসের সঙ্গে নারীদের জামাতে অংশ নিলেন। তিনি নারীশিক্ষার পক্ষে ছিলেন। নারীশিক্ষার পক্ষে তিনি তাঁর ছাত্রীদের অনেক সাহায্য করতেন। বেগম সুফিয়া কামাল, শামসুন্নাহার মাহমুদ সহ যারা নারী শিক্ষা আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে তাঁর ভালো সম্পর্ক ছিলো। নারী শিক্ষা আন্দোলন, সামাজিক আন্দোলনগুলোতে তিনি অংশ নিয়েছেন।”
এই মহান মনীষী ১৯৬৯ সালের ১৩ই জুলাই শেষ নিঃশ ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ঢাকা হলের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর সম্মানার্থে সে বছরই হলটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হল।
(সহায়ক গ্রন্থ: মনসুর মুসা, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, ১৯৯৩। বাংলা একাডেমী, জীবনীগ্রন্থমালা সিরিজ)