অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

ঋতুকালীন স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন হয়ে উঠছেন আজকের মেয়েরা


ভারতের প্যাডম্যান’ তামিলনাড়ুর অরুণাচলম মুরুগানানথম বলেছিলেন, “নারীদের চাঁদে বা মঙ্গল গ্রহে পাঠাবেন পরে, প্রথমে তাঁদের জন্য স্যানিটারি প্যাড-এর ব্যবস্থা করুন।” মুরুগানানথম-ই প্রথম গ্রামীণ ভারতে যাতে মহিলারা সস্তায় স্যানিটারি ন্যাপকিন পান ও তাঁদের ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ভালো থাকে তারজন্য কম খরচে স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরির যন্ত্র তৈরি করেছিলেন, যা আমূল পরিবর্তন আনে ভারতে গ্রামীণ ও সুবিধাবঞ্চিত মহিলাদের ঋতুকালীন স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়ার আলোচনায় ও বাস্তবচিত্রেও। নিঃসন্দেহে, মহিলাদের জন্য সুলভে স্যানিটারি ন্যাপকিন পরিষেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে তিনি এক বড়সড় সামাজিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল এই যন্ত্রের হাত ধরে।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার বছর চব্বিশের রেহানা খাতুন জানাচ্ছেন, “প্রথম দিকে ঋতুস্রাব নিয়ে কথা বলতে গেলে ভয় কাজ করত, লজ্জাও লাগত।” এই ভয় এবং লজ্জা একমাত্র রেহানার নয়। পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম, শহরতলীর বিভিন্ন বয়সের মহিলারা বিশেষত বয়ঃসন্ধির কিশোরীরা মাসিকের সময় ভয় ও লজ্জায় একপ্রকার কুঁকড়ে থাকেন। সেন্টার ফর অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড রিসার্চ সংস্থার পশ্চিমবঙ্গ শাখার কর্মী, সুদীপা সামন্ত জানাচ্ছেন, “ঋতুকালীন স্বাস্থ্য এবং পরিচছন্নতা সম্পর্কে না জানার কারণে মহিলাদের মধ্যে বিভিন্ন সংক্রমণ ঘটে, শারীরিক সমস্যা তৈরি হয়।”

সব মিলিয়ে সার্বিকভাবে, ঋতু সংক্রান্ত স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা রক্ষার বিষয় সম্পর্কে আরো বেশি করে সচেতনতা তৈরি, স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার গুরুত্ব প্রচারের উদ্দেশ্যেই ২০১৪ সাল থেকে ২৮শে মে প্রতি বছর সারা পৃথিবী জুড়ে পালিত হয় মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন ডে বা ঋতুকালীন স্বাস্থ্য দিবস।

ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা

ইউনিসেফের গাইডলাইন অনুযায়ী, ঋতুকালীন অবস্থায় নারীদেহের রক্তপাত সামলানোর জন্য ব্যবহৃত উপাদান, পরিষ্কার থাকার জল ও সাবান, মাসিকের বর্জ্য সঠিকভাবে ফেলা, শারীরিক অসুবিধার জন্য স্বাস্থ্য পরিকাঠামো, মাসিক সংক্রান্ত যাবতীয় শিক্ষা ও সচেতনতা — এই বিষয়গুলিকেই মেনস্ট্রুয়াল হেলথ এন্ড হাইজিন অর্থাৎ ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতার আওতায় ধরা হয়। জার্মানির ওয়াশ ইউনাইটেড সংস্থার মানবাধিকার বিভাগের প্রধান হ্যানা ন্যুমার-এর মত অনুযায়ী, “মেয়েদের মানবাধিকার ক্ষতিগ্রস্ত হয় যখন একজন মেয়ে তার মাসিকের দিনগুলি মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকতে পারেন না।” একথা মাথায় রেখেই ইউনিসেফ সম্প্রতি ঋতুকালীন স্বাস্থ্য রক্ষাকে মানবাধিকার রক্ষার অংশ হিসেবেই তুলে ধরেছে।

আবার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঋতুস্রাব বিষয়টিকে এমন এক স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখছে যার শারীরিক এবং মানসিক দিক যেমন রয়েছে, সামাজিক দিকও রয়েছে। তাই, স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার পাশাপাশি, মাসিক সংক্রান্ত সামাজিক বিধি-নিষেধ ভাঙার দিকেও জোর দিচ্ছেন তাঁরা।

ঋতুকালীন অবস্থা কীভাবে সামলাচ্ছেন মেয়েরা?

২০২২ এ ভারতে প্রকাশিত, ভারতের ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেল্থ সার্ভ-এর বিবৃতি অনুযায়ী স্যানিটারী ন্যাপকিন, টেম্পুন এবং মেনস্ট্রুয়াল কাপকেই ঋতুস্রাবের জন্য ব্যবহার করা যায় এমন পরিচ্ছন্ন উপাদান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই সার্ভের তথ্যই বলছে ঋতুকাল সামলাতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন উপাদান ব্যবহার করার সুযোগ পান ভারতে প্রায় ৭৭ শতাংশ মহিলারা। পশ্চিমবঙ্গে এই সংখ্যাটা গ্রামীন এলাকায় প্রায় ৭৯ শতাংশ, শহর এলাকায় প্রায় ৯১ শতাংশ। স্যানিটারি ন্যাপকিন যারা ব্যবহার করতে পারেন না, সেইসমস্ত মহিলাদের এখনও পর্যন্ত সাধারণ কাপড়ের ওপরেই নির্ভর করতে হয়।

পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ অঞ্চলে মেয়েরা ঋতুকালীন অবস্থায় কীভাবে কাটান সে বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ কনটেম্পোরারি মেডিকেল রিসার্চে, ২০২০ সালে। ড. কাকলি বড়াল ও অন্যান্যদের তৈরি করা সেই গবেষণাপত্রে দেখা যাচ্ছে, বেশ কিছু মেয়েরা বিভিন্ন ধরনের খাবার, কাজকর্ম, বাইরে বেরনো – এসব বিষয়ে নানা বিধিনিষেধ মেনে চলেন ঋতুস্রাবের দিনগুলিতে। এই গবেষণায় আরো উঠে এসেছে, তাঁরা যে সমস্ত মেয়েদের উপর সমীক্ষা করেছেনতাঁদের এক-তৃতীয়াংশ জানেন না ঋতুস্রাবের রক্ত শরীরের কোথায় তৈরি হয়। এ প্রসঙ্গেই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার দশম শ্রেণীর ছাত্রী আঁখি ঘোষ জানাচ্ছেন, “বাড়ির বড়রা এবং বন্ধু-বান্ধবীদের অনেকেই মাসিক সম্পর্কে ঠিকঠাক ভাবে জানে না। মাসিকের সময় খাওয়া-দাওয়া নিয়ে অনেক বাধা-নিষেধ থাকে, অনেক আচার-বিচারের কথা তারা বলে। কিন্তু, এটা প্রাকৃতিক ঘটনা। মেয়েদের শরীরে এটা হবেই। আমাদের স্কুলে এ বিষয়ে একবার ওয়ার্কশপ করানো হয়েছিল; এছাড়া জীবনবিজ্ঞান বইয়ে যতটুকু জেনেছি সেটাই আমি তাদের বোঝাই।”

ঋতুকালীন স্বাস্থ্য রক্ষায় সরকারি সহায়তা

ভারত সরকারের উদ্যোগে রাজ্যগুলিতে, তৃণমূল স্তরে আশা প্রকল্পের কর্মীরা মেয়েদের যৌন স্বাস্থ্য ও মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্য রক্ষার কাজ করে থাকেন। পশ্চিমবঙ্গের আশা কর্মী ইউনিয়নের রাজ্য সম্পাদিকা ইসমাত আরা খাতুন জানাচ্ছেন, “মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যের পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগে কিশোরীদের স্বাস্থ্য নিয়েও আমরা কাজ করি। কিশোরীদের কাছে এই সময় শারীরিক পরিবর্তন নিয়ে বেশ একটা ভীতি তৈরি হয়। আমাদের মা, ঠাকুমাদের সময় এত সচেতনতা ছিল না। সেখান থেকে অনেক অসুবিধাও তৈরি হত। এখন সময় পাল্টেছে। কিশোরী মেয়েদের মাসিকের দিনগুলিতে কীভাবে পরিচ্ছন্ন থাকবে তা শেখানো হয়।” তিনি আরো জানাচ্ছেন, “আশা কর্মীরা সরকারি নির্দেশে, ‘সাথী’ নামের স্যানিটারি ন্যাপকিন খুবই অল্প দামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মহিলাদের কাছে বিক্রি করেন। কিন্তু, ব্যবহারকারীরা এই স্যানিটারি ন্যাপকিনের গুণগত মানে একেবারেই খুশি নন।” এই সমস্যার প্রেক্ষিতেই তিনি বলছেন, “সরকারের উচিত সদর্থক ভাবেই ভালো মানের জিনিস মেয়েদের দেওয়া। সবার সামর্থ্য থাকে না বেশি দাম দিয়ে বাজার থেকে ন্যাপকিন কেনার। আবার, সরকারের দেওয়া স্যানিটারি ন্যাপকিনে যথাযথ কাজ না হলে তাদের কাপড় বা অন্যান্য জিনিসই ব্যবহার করতে হয়, যা মোটেও স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী নয়।” তিনি আরো যোগ করেন, “প্রত্যেকের পরিচ্ছন্ন মাসিকের অভ্যেস তৈরিতে স্যানিটারী ন্যাপকিন বিনা পয়সায় মেয়েদের দিলে তা সবচেয়ে কার্যকরী হয়ে উঠবে।”

সচেতনতা তৈরিতে এগিয়ে আসে এনজিও ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থারা

পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার বিভিন্ন ব্লকে গত দু’দশক ধরে ঋতুকালীন স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছে “নারী ও শিশু কল্যাণ সমিতি”। এই সমিতির রহিমা খাতুনের সঙ্গে কথা বলেছে ভয় সব আমেরিকা। রহিমা খাতুন জানাচ্ছেন, “প্রাথমিকভাবে সৃজন নেটওয়ার্কের সহায়তায় আমরা মহিলাদের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ শুরু করি। এই কাজ করার সময় দেখা যায়, মহিলাদের মধ্যে মাসিকের সময় কাপড় ব্যবহার করা এবং সেই কাপড় সঠিকভাবে পরিষ্কার না করার প্রবণতা খুবই বেশি। তাই, ২০০৪ সালের পরবর্তী সময়ে অন্যান্য স্বনির্ভর গোষ্ঠী সহায়তায় সুলভে স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরির ইউনিট চালু করা হয়। রাজ্যের অন্যান্য জেলা থেকেও মেয়েরা এসে আমাদের কাছে ন্যাপকিন তৈরির ট্রেনিং নিয়ে যান। প্রতিবেশী রাজ্য বিহার এবং ঝাড়খন্ডে, আমাদের এই কাজকে মডেল হিসেবে নিয়েছে। মেয়েদের স্বাস্থ্য নিয়ে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের অংশীদার হিসেবেও আমরা কাজ করছি।” তাঁকে যখন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় তিনি জানান, “ন্যাপকিন তৈরির ক্ষেত্রে এবং অন্যান্য বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের ট্যাক্স দিতে হয়। এই ট্যাক্স যদি ছাড় দেওয়া হয়, অল্প পয়সায় আরো স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি ও বিতরণ করা সম্ভব।”

আবার, এনজিও সংস্থা সেন্টার ফর অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড রিসার্চ-এর পশ্চিমবঙ্গ শাখার কর্মী সুদীপা সামন্ত জানাচ্ছেন, “২০১৪ থেকে আমরা জলের ব্যবহার, স্বাস্থ্যবিধি ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ঋতুকালীন স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা নিয়ে একটানা কাজ করছি। প্রথমদিকে, হেল্থ ক্যাম্প করা হত। যেসব মহিলারা সেখানে আসতেন, তাদের বেশিরভাগেরই স্ত্রী রোগের সমস্যা। দেখা যায় যে, ঋতুস্বাস্থ্য নিয়ে তাঁরা বিশেষ জানে না। নোংরা কাপড় ব্যবহার করা, পুকুরের জলে স্নান করা ইত্যাদি কারণে শরীরে নানা রোগ হচ্ছে। তারপর, সেই সমস্ত মহিলাদের, সবাইকে এ নিয়ে ওয়ার্কশপ করানো হয়, নিয়মিতভাবে ক্লাস নেওয়া হয়।” ওই ক্লাসগুলি ঋতুকালীনধ্যান ধারণা একেবারে পাল্টাতে সাহায্য করে — এমনটাই দাবি করছেন রেহানা খাতুনের মত যুবতীরা।

অন্যদিকে, ২০১৯ সালে প্রকাশিত এনজিও দশরা-র একটি প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বছরে প্রায় ২৩ মিলিয়ন কিশোরী ঋতুস্রাব সংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনার অভাবে স্কুল ছেড়ে দেয়। স্কুলে কিশোরীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরিতেও এগিয়ে এসেছে সেন্টার ফর অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড রিসার্চ-এর মত সংস্থা। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণাজেলার বিভিন্ন স্কুলে মেয়েদের এমনকি, ছেলেদের মধ্যে কিশোর অবস্থায় শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে ওয়ার্কশপ করান তাঁরা। সুদীপা সামন্ত -র কথায়, “প্রথম দিকে অল্প সংখ্যক মেয়েরাই আসতো, তবে তাদের কাছে শুনে, আমাদের ক্লাসগুলি থেকে উপকৃত হয়ে আরো অনেক কিশোরী এবং মহিলারা ধীরে ধীরে যোগদান করতে থাকেন।” আর, রেহানার মত মেয়েরা নিজেরা যেমন শিখছে, তেমনি আরো অনেক মেয়েদের সচেতনতার পাঠ দিয়ে চলেছে প্রতিদিন। সুদীপা এও জানাচ্ছেন, “আমাদের কর্মীদের মধ্যেই ঋতুস্রাবনিয়ে অনেক ভুল ধারণা ছিল। ওয়ার্কশপ করতে গিয়ে নিজেরাও অনেক নতুন কিছু শিখেছি।”

ওই সংস্থারই কাজকর্ম পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সুতীর্থ ঘোষাল এঁর কথায়, “ঋতুকালীন স্বাস্থ্যের উন্নতিতে পুরুষদের অংশগ্রহণকেও আমরা গুরুত্ব দিয়েছি। ওয়ার্কশপগুলোতে কিশোর এবং পূর্ণবয়স্ক পুরুষদের সামিল হতে উৎসাহ দেওয়া হয়। মাসিক সংক্রান্ত জ্ঞান শুধুমাত্র মহিলাদের কাছ থেকেই নয়, একজন পুরুষের কাছ থেকেও যে শেখা যেতে পারে, সেই দৃষ্টান্তই আমরাতৈরি করতে চাই।”

XS
SM
MD
LG