বাংলাদেশে চলতি বছর গ্রীষ্মকালে আক্ষরিক অর্থেই দাবদাহ চলছে। দিনে প্রচন্ড গরম আর কাঠফাটা রোদ। রাতের তাপমাত্রা কিছুটা কমলেও গরম কমেছে না খুব একটা। কখনও কখনও তাপমাত্রা বেড়ে ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রিও হচ্ছে। গত এপ্রিল মাসে রাজধানী ঢাকায় সবচেয়ে বেশি পরিমাণ তাপমাত্রা (৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস) রেকর্ড করা হয়েছে যা বিগত ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আবহাওয়ার এমন পরিস্থিতির প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে শিশুদের ওপর।
এ সময়ে শিশুর অসুখ-বিসুখ ও সতর্কতা
এই আবহাওয়া শিশুদের জন্য ভীষণ কষ্টকর। এ সময়ে শিশুরা সর্দি-কাশি, ঠান্ডা লেগে জ্বর, পেটের অসুখ, ডায়রিয়া, টাইফয়েডে ভুগতে পারে। সে কারণে গরমে শিশুদের বিশেষ যত্ন প্রয়োজন। বিশেষত ছোট শিশু ও নবজাতকের বিশেষভাবে যত্ন করতে হবে। এ বিষয়ে ভয়েস অফ আমেরিকার সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের চিকিৎসক ডাঃ মো. মেহেদী হাসান। তিনি বলেন, “গ্রীষ্মকালে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে আর্দ্রতা বেশি থাকে। যেসব শিশুরা ঘনবসতিপূর্ণ ঘিঞ্জি পরিবেশের মধ্যে থাকে, যেসব বাসস্থানে যথাযথ ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা নেই, আলো বাতাস কম চলাচল করতে পারে সেসব জায়গায় বসবাস করা শিশুরা এই আবহাওয়াতে বেশি রোগাক্রান্ত হতে পারে। গরমে শরীরে যে ঘাম হয় তা থেকে ঠান্ডা লাগা, কাশি হতে পারে। বিশেষ করে যাদের চাইল্ডহুড এ্যাজমা আছে অথবা পারিবারে এ্যাজমার ইতিহাস আছে, সেসব শিশুদের গরম থেকে ঘেমে প্রায় সময়ই হাঁচি-কাশি হতে দেখা যায়, সর্দি লাগে এবং তাদের যে হাঁপানির প্রকোপ আছে তা বেড়ে যায়। তাছাড়া অত্যাধিক গরম থেকে ডায়রিয়া ও অন্যান্য শারীরিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলোও দেখা দিতে পারে। গরম, ঘাম ও ধুলাবালি থেকে ঘামাচি ও অন্যান্য চর্মরোগ দেখা দিতে পারে। শিশুরা স্কুলে যখন খেলাধুলা করে তখন ঘাম ও ধুলোবালি থেকে অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া রাস্তার খাবার, পানি, বাইরে তৈরি ফলের জুস, বাইরে কেটে রাখা আমড়া, পেয়ারা, আনারস ইত্যাদি ফল খাওয়ার ফলেও শিশুদের বমি, পেট ব্যথা, ডায়রিয়ার মতো অসুখ বিসুখ হতে পারে।”
এ ধরণের অসুখ-বিসুখের হাত থেকে শিশুকে রক্ষা করার উপায় হিসেবে ডাঃ মেহেদী বলেন,
· যখনই শিশুর শরীরে ঘাম হবে শরীর ভালো করে মুছে দিতে হবে।
· শিশুর শরীর যেনো ভেজা বা ঘর্মাক্ত অবস্থায় না থাকে সেটা লক্ষ রাখতে হবে।
· বাইরের আবহাওয়া অত্যধিক গরম হলে দিনে দুবার সকাল এবং সন্ধ্যায় শিশুকে স্নান করানো উচিত।
· একদম ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে বারবার স্নান না করিয়ে ঘেমে গেলে নরম পাতলা সুতি কাপড় ভিজিয়ে শরীর মুছে দিতে হবে।
· বাসায় আলো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকা খুব জরুরী। দরজা জানালা খোলা রাখতে হবে যাতে ঘরে ঠিকমতো বাতাস চলাচল করতে পারে। ঘরের আবহাওয়া স্যাঁতসেঁতে, আর্দ্র হলে শিশুরা বেশি অসুস্থ হতে পারে।
ছোট শিশু ও নবজাতকের যত্নের ব্যাপারে তিনি আরো বলেন, “শিশুদের খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে বাড়তি যত্ন করতে হবে। প্রচুর পানি, ফলের রস খাওয়াতে হবে। যেসব শিশু শুধু মায়ের দুধ পান করে তাদের বেশি বেশি মায়ের দুধ পান করাতে হবে। আমরা বারবারই বলি, গরমে পানিশূণ্যতা হয়। শিশুর পানিশূণ্যতা দেখা দিয়েছে কিনা সেটা আমরা বুঝতে পারি শিশু দিনে কতবার প্রস্রাব করলো এবং প্রস্রাবের পরিমাণের উপর। যদি এর পরিমাণ কম হয় এবং দৈনিক কমপক্ষে পাঁচ থেকে ছয়বার প্রস্রাব না করে, এবং শিশুর অতিরিক্ত পিপাসা থাকে সেক্ষেত্রে আমরা মনে করি যে শিশুটির পানিশূণ্যতা রয়েছে। এজন্য এ সময়ে শিশুদের পানি, ফল, শরবত বেশি করে খাওয়ানো উচিৎ। এই সিজনে পানিবাহিত অসুখও হতে পারে। যেমন: ফুড পয়েজনিং, ডায়রিয়া ইত্যাদি হতে পারে। তাই ছোট শিশুদের ফিডার, ফুটানো পানি দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। খাওয়ার আগে শিশুর হাত ভালোভাবে সাবান দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে।”
স্কুলগামী শিশুর খাবার
গরমকালে শিশুদের দৈনন্দিন খাবার বিশেষত স্কুলগামী শিশু সারাদিনে কী খাবে সে ব্যাপারে ভয়েস অফ আমেরিকার সাথে কথা বলেছেন পুষ্টিবিদ ও এভার কেয়ার হাসপাতাল, ঢাকার প্রিন্সিপাল ডায়েটিশিয়ান তামান্না চৌধুরী। তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী, এখন যেহেতু বেশ গরম তাই তাপমাত্রার সাথে মিলিয়ে বাচ্চাদের সুস্থতার বিষয়টা আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। সেজন্য শিশুদের টিফিন এবং তাদের সারাদিনের খাবারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত মনে রাখতে হবে শিশুর স্কুলের সময় - তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে খাবারগুলো ঠিক করতে হবে। যেমন যেসব শিশু সকালে বের হচ্ছে অর্থাৎ যাদের মর্নিং শিফটের স্কুল তাদেরকে অবশ্যই সকালবেলা একটা ভালো জলখাবার খাওয়াতে হবে। কেননা ব্রেকফাস্ট না করে গেলে টিফিনে যদি সরাসরি কোন ভাজা-পোড়া খাবার এই গরমে খালি পেটে খায় তাহলে শিশুর পেটে ব্যথা, গ্যাস, কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। খুব সহজে হজম হয়, শিশু অনেকক্ষণ এনার্জিটিক থাকে এ ধরনের খাবারগুলো সকালের জলখাবার হিসেবে দিতে হবে। বাচ্চাদের সকালের নাস্তার মধ্যে প্রধান পুষ্টিগুণ বিশেষ করে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল, এই জিনিসগুলো যেন থাকে যেমন : ডিম-রুটি-সবজি, দুধ-ওটস-কলা অথবা চিড়া-দই-কলা এবং এসব খাবারের সাথে একটা ডিম। এভাবে প্রতিদিন একই খাবার না দিয়ে খাবারে বৈচিত্র আনতে হবে।
শিশুদের টিফিনের বিষয়ে তামান্না বলেন, “মর্নিং শিফটের স্কুলের শিশুদের টিফিনে খুব বেশি ভাজাপোড়া খাবার না দেয়া উচিৎ। বাইরের খাবার একেবারেই দেয়া উচিৎ না। দ্রুত পচনশীল খাবার, গরমের কারণে গন্ধ হয়ে যেতে পারে এ ধরনের খাবার টিফিনে না দেয়াই ভালো। গরমের দিনে শিশুদের হালকা টিফিন যেমন ছোট ছোট দইয়ের কন্টেইনার অথবা মৌসুমী ফল যেমন: টুকরো করা পেয়ারা, মালটা (মোসাম্বি), ড্রাই ফ্রুটস যেমন: বাদাম, কিসমিস খেজুর মিশিয়ে দেয়া যেতে পারে। এগুলো ভালো টিফিন হতে পারে। সেই সাথে বিভিন্ন ধরনের ক্র্যাকার্স বিস্কিট, কুকিজ দেয়া যেতে পারে। ফল, বিস্কিট, ড্রাই ফ্রুটস টিফিনের জন্য এ সময়ের আদর্শ খাবার। এ ধরনের খাবার খেলে শিশু হাইড্রেট থাকে, ভিটামিন ও মিনারেল-এর অভাব পূরণ হয়। এছাড়া শিশুকে বাসা থেকে পানির পটে পানি দিয়ে দিতে হবে। সারাদিনে সে পানিটা ঠিকমতো খাচ্ছে কিনা, ঠিকমতো ইউরিন পাস করছে কিনা সেই বিষয়গুলো বাবা-মাকে খেয়াল রাখতে হবে এবং এ ব্যাপারগুলো কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা শিশুকে বুঝিয়ে দিতে হবে। স্কুল থেকে আনতে যাবার সময় শিশুর জন্য ডাবের পানি, ফলের রস নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। তাতে শিশু সতেজ বোধ করবে এবং প্রয়োজনীয় শক্তিও পাবে।’’
ডে শিফটে স্কুল করা শিশুদের সকালের খাবার এবং টিফিনের বিষয়ে তামান্না বলেন, “যেহেতু দুপুরে ভারী লাঞ্চ শিশুর পক্ষে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না এবং স্কুলে অনেকক্ষণ ধরে দুপুরের খাবার খাওয়া সম্ভব নয় তাই দুপুরের খাবারটা তারা স্কুলে যাবার আগেই খেয়ে বের হবে তাহলে অনেক সময় ধরে এনার্জেটিক থাকবে। এবং দুপুরে বাচ্চাদের টিফিনে ব্রেডের সঙ্গে জ্যাম, মাখন-রুটি, স্যান্ডুইচ এ ধরনের হালকা খাবার থাকতে পারে। বিকেলে এসে দুধ-কর্নফ্লেক্স, দুধ সেমাই, নুডুলস, ডিম সেদ্ধ অর্থাৎ যে খাবারগুলো তারা সকালে খেত সেগুলো বিকালে এসে খেতে পারবে। তাহলে মর্নিং এবং ডে উভয় শিফটের বাচ্চাদের ঠিকঠাকমতো পুষ্টি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।”
শিশুর দৈনন্দিন খাবার, পানি, ঘুম ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনা
গরমে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তাই খুব তাড়াতাড়ি বিভিন্ন পেটের অসুখে ভুগতে পারে। সেজন্য শিশুদের দুপুরের ও রাতের খাবারটাও খুব হালকা হতে হবে বলে জানালেন পুষ্টিবিদ তামান্না। তিনি বলেন, “অবশ্যই মাছের বা মুরগির পাতলা ঝোল, ভাত, সবজি, পাতলা ডাল ইত্যাদি দুপুরের এবং রাতের খাবারের মেনুতে থাকতে হবে। অতিরিক্ত তেল-মশলা দেয়া খাবার, ঝাল খাবার, পোলাও-বিরিয়ানি ইত্যাদি ভারী খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। শিশুদের অবশ্যই রাতের খাবার তাড়াতাড়ি খাওয়ানোর চেষ্টা করতে হবে এবং রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হবে। এই গরমে ঘুমের ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে যাতে সারাদিনে শিশুর ক্লান্ত না লাগে। স্কুল থেকে এসে সরাসরি ফ্রিজের ঠান্ডা পানি খাওয়া যাবে না। শিশুর বয়স ও শারীরিক ওজন অনুযায়ী পানি পান করবে। সাধারণত আমরা শিশুদের বয়সভেদে ছয় থেকে আট গ্লাস পানি খেতে বলি।
হিটস্ট্রোক থেকে বাঁচতে
ডা. মেহেদী বললেন, “কিছুদিন আগে যেহেতু আমাদের দেশের তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি থেকে ৪২ ডিগ্রি পর্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল, এরকম অত্যাধিক গরমে স্কুলগোয়িং শিশুদের হিটস্ট্রোক থেকে বাঁচাতে করণীয়:
· রোদ এড়িয়ে চলতে হবে। স্কুলে হেঁটে যাতায়াত করলে ছাতা ব্যবহার করতে হবে।
· হিটস্ট্রোক থেকে বাঁচার বড় উপায় হলো বেশি বেশি পানি বা তরল খাবার খাওয়া।
· শিশুকে সুতি কাপড় চোপড় পরিধান করাতে হবে। স্কুল ড্রেস সুতি কাপড়ের হওয়া বাঞ্ছনীয়।
এছাড়া ভেজা স্যান্ডো গেঞ্জি পাল্টে দিতে হবে। ঘামে ভেজা গেঞ্জি থেকে বুকে ঠান্ডা বসে যেতে পারে। স্কুল থেকে ফেরার পর ঘামে ভেজা স্কুলড্রেস খুলে ফেলতে হবে।”