অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

আমার কী আছে? আমার কন্ঠ আছেঃ ৭১'র স্মৃতিচারণে শাহীন সামাদ


শিল্পী শাহীন সামাদ। (সৌজন্য ছবি)
শিল্পী শাহীন সামাদ। (সৌজন্য ছবি)

প্রথিতযশা সংগীত শিল্পী শাহীন সামাদ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন কন্ঠসৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শিল্পী সংস্থার’ সদস্য হিসেবে ছুটে বেড়ান শরণার্থী শিবির থেকে রণাঙ্গনের নানা প্রান্তে৷ তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন শিল্পী ছিলেন। এখনো নিয়মিত সংগীতচর্চা করছেন, শিক্ষার্থীদের শেখাচ্ছেন। কিংবদন্তী এই সংগীত শিল্পী মুক্তিযুদ্ধের নানা স্মৃতি নিয়ে কথা বলেছেন ভয়েস অফ আমেরিকার সঙ্গে। ভয়েস অফ আমেরিকার পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আফরিন শাহনাজ।

ভয়েস অফ আমেরিকা: ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় সাংস্কৃতিক আন্দোলন যারা করেছেন, তাদের মধ্যে আপনিও একজন। সে সময়ের কথা শুনতে চাই।

শাহীন সামাদ: ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় আমরা সমস্ত শিল্পীরা রেডিও বয়কট করি। তখন আমি ছায়ানটের ছাত্রী ছিলাম। ছায়ানটে আমরা শিক্ষক হিসেবে যাদের পেয়েছি তাদের মধ্যে একজন আমাদের গণসংগীতের সম্রাট শেখ লুৎফুর রহমান। সেই সময় আলতাফ ভাই, অজিত রায়, সুজেয় শ্যাম দা ছায়ানটে যেতেন। পটুয়া কামরুল হাসান আমাদের ব্রতচারী শিখিয়েছিলেন। আর যারা গিয়েছেন তারা নানা ধরণের গান শিখিয়েছেনে। স্পেশালি লুৎফুর ভাইয়ের স্নেহের ছায়ায় আমি প্রচুর গান শিখেছি। এইসব গানগুলোই আমরা পরে শহিদ মিনার, ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট, রমনার বটমূল এরকম বিভিন্ন জায়গায় গেয়েছি। আমার এখনও মনে পড়ে, সে সময় জাহেদুর রহিম নামে একজন নামকরা রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ছিলেন। তিনি বেশ লম্বা, চওড়া ছিলেন। ওনার গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে আমরা সবাই তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে গণসংগীতগুলো গাইতাম। আমরা সবাই মনের মধ্যে একটা শক্তি যোগানোর চেষ্টা করতাম। কারণ সামনের দিনগুলোয় যে কিছু একটা হবে সেটাতো সবাই বুঝতেই পারছিলাম। সেই চেতনাটাকে জাগ্রত করার জন্যই আমরা সেই শক্তিশালী গানগুলো গাইতাম। কিন্তু এ কাজগুলো আমরা বাধাহীনভাবে কখনো করতে পারিনি। সবসময় পুলিশের ধাওয়া খেতে হতো। তখন ছত্রখান হয়ে এদিক সেদিক পালাতে হতো। তারপর আবার একত্র হতাম, আবার গান গাইতাম। এভাবেই চলতো।

ভয়েস অফ আমেরিকা: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের পেছনে কোন বিষয়টি সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করেছিলো?

শাহীন সামাদ: আমি বলব, আমাকে যেটা আলাদাভাবে শক্তি জুগিয়েছিলো সেটা হলো আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের ভাষণ। সোহরওয়ার্দী উদ্যানে তাঁর যে আটাশ মিনিটের বক্তৃতা, সেটা কিন্তু আমার মনটা একদম চেঞ্জ করে দিলো। কারণ উনি যখন বলেছিলেন, “যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ো।” তখন ভাবলাম, “আমার কী আছে? আমার কন্ঠ আছে।” যে কোনো দেশে যখন কোনো সংকট আসে, সেই সংকট নিরসনে সাংস্কৃতিক অঙ্গনই কিন্তু সোচ্চার হয়। আমরাও তাই করেছি। কিন্তু সেই সাতই মার্চের ভাষণ আমার ভেতরে একটা অন্যরকম পরিবর্তন নিয়ে এসেছিলো।

ভয়েস অফ আমেরিকা: যুদ্ধে যাওয়ার গল্পটা শুনতে চাই।

শাহীন সামাদ: আমার বাবা মারা গেছেন ১৯৬৬ সালে, আমাকে ছায়ানটে ভর্তি করে দিয়ে । আমার মা-ই ছিলেন সব কিছু। আমাদের বাসা ছিলো লালবাগ ফোর্টের ঠিক উল্টোদিকে। এই ফোর্টে পরে আর্মি ক্যাম্প করা হয়। আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে যুদ্ধে চলে গিয়েছিলাম। সে রাতে ব্ল্যাক আউট ছিলো। আমাকে সহযোগিতা করেছিলেন আমার কলেজের একজন শিক্ষক জাকি আপা। উনি বাসায় এলেন। আম্মা ওনাকে খুব বিশ্বাস করতেন। ওনার সহযোগিতায় আমি এক কাপড়ে বাসা থেকে বের হয়ে চলে যাই। প্রথমে আজিমপুরে যাই। সবাই তো সঙ্গী সাথী নিয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু আমি তো গিয়েছি একা। একা তো কলকাতায় যেতে পারবো না , সে রাতেই কাজী বাড়িতে মাহমুদুর রহমান বেণুর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। আম্মাকে ফোন করা হলো। আম্মা খুব কান্নাকাটি করলেন। আম্মাকে বোঝালাম, “আম্মা আমি দেশের কাজে যাচ্ছি। যদি বেঁচে থাকি, ফিরে আসবো। নিশ্চয়ই দেখা হবে।” এভাবে জাকি আপা সহ সেখানে আমরা তিনদিন অবস্থান করি। তারপর বোরখা পরে রওনা দেই। চান্দিনা থানা হয়ে আমরা আগরতলায় পৌঁছাই। এখানেও একটি কাহিনী আছে, চান্দিনা পৌঁছানোর পর দূর থেকে দেখলাম, একটি আর্মির গাড়ি আসছে। আমাকে বেণু বলল, “খবরদার, তুমি বোরখার মুখের কাপড়টা উঠিও না।” আমি চুপ করে বসে থাকলাম। আর্মির জিপ থেকে দুজন নামলো। এসে বলল, “কাঁহা যা রেহে হো।” বেণু বলল, “হামলোগ শাশুরাল যা রেহে হ্যায়।” একজন আমার বোরখার মুখটা উঠাবে, তখন পাশের আর্মি বলল, “ছোড় দো, ছোড় দো, যানে দো।” এ ঘটনা আমি জীবনেও ভুলবো না। আমার সাথে তো অন্য কিছুও হতে পারতো।

১৯৭১ সালে নৌকাযোগে যাত্রাপথে শিল্পী শাহীন সামাদ। (ছবি: সৌজন্য)
১৯৭১ সালে নৌকাযোগে যাত্রাপথে শিল্পী শাহীন সামাদ। (ছবি: সৌজন্য)

তারপর আমরা আগরতলায় পৌঁছলাম। সেখানে আমরা তিনদিন ছিলাম, তারপর কলকাতায়। যখন দেশের জন্য কিছু করা হয়, তখন অন্য কোনো কষ্টের কথা মাথায় থাকে না। যেমন আমাদের বিয়ে হয়েছিলো, কিন্তু আমরা আলাদাই ছিলাম। আমরা দেশের কাজের জন্য গিয়েছিলাম, তো যার জন্য ছেলেরা আলাদা থাকতো, মেয়েরা আলাদা থাকতো। পাটি বিছিয়ে থাকতাম, কোনো বালিশ-টালিশ ছিলো না। খেতে দিতো কলাপাতায় এক চামচ করে খিচুড়ি আর এক পিস বেগুন ভাজা। ওটাই সারাদিনের খাবার ছিলো অথচ সেটাই অমৃত মনে হতো। কলকাতায় ১০৪ নম্বর পার্ক স্ট্রিটে আমার খালাশাশুড়ি ছিলেন। ওখানে গিয়ে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অনেককে পেলাম। তাদের মধ্যে আলী জাকের, আসাদুজ্জামান নূর, এনামুল হক সহ আরো অনেকে ছিলেন। সেখান থেকেই জানলাম ১৪৪ নম্বর লেনিন স্মরণীতে লেখক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায় ওনার বাসার নিচতলা ছেড়ে দিয়েছিলেন আমাদের রিহার্সালের জন্য। ডালিয়া নওশিন রিহার্সাল করাতেন। সেখানে গিয়েও আমরা বাংলাদেশের অনেককে পেয়েছিলাম। সনজীদা আপা, ওয়াহিদ ভাই, এনামুল হক,বিপুল ভট্টাচার্য, তারেক আলী, সৈয়দ হাসান ইমাম এরকম আরো অনেকে। এভাবে সবাইকে পেয়ে মনের মধ্যে জোর পেলাম, ভরসা পেলাম যে, না আমি এখানে একা না।

ভয়েস অফ আমেরিকা: আপনি তো ‘বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম শিল্পী সংস্থা’র সদস্য ছিলেন। তো এই সংগঠন থেকে আপনাদের কী কী কার্যক্রম ছিলো? শরণার্থী শিবির ও রণাঙ্গণে আপনার অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাই।

শাহীন সামাদ: আমাদের কার্যক্রম ছিলো পশ্চিমবঙ্গের অনুষ্ঠানগুলো ধরা। পুরো পশ্চিমবঙ্গ আমরা কাভার করেছি। টাকা পয়সা যোগাড় করতে হবে। সংগঠন থেকে আমরা যারা বিবাহিত ছিলাম, তাদেরকে একশত টাকা করে আর অবিবাহিতদের পঞ্চাশ টাকা করে দেয়া হতো। আমাদের খাওয়া-দাওয়ার কোনো ঠিক ছিলো না। এক কাপড়েই ঘুরে বেড়াতাম। আমরা বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে প্রচুর অনুষ্ঠান করেছি, গান করেছি। আমাদের সংগঠন থেকে একটা ট্রাক আসতো। সেই ট্রাকে শরণার্থী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সমস্ত খাবার দাবার, ওষুধপত্র, হাড়িপাতিল, কাপড় সবকিছু থাকতো। বস্তায় বস্তায় সবকিছু আসতো। কিছুদিন পর শীত আসবে, তাই কম্বলও দেয়া হতো। আমরা বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে গিয়ে এসব খাবার, ওষুধ পত্র দিয়ে আসতাম।

শরণার্থী ক্যাম্পের দৃশ্য আমি ভুলি না। চারিদিকে এত আহত মানুষ। চিৎকার, হাহাকার, কান্না। কারো পা নেই, কারো হাত নেই। কারো চোখ উড়ে গেছে। সে সব দৃশ্য ভোলা যায় না। এইসব ক্যাম্পে ক্যাম্পে আমরা গান গেয়েছি। তাদের মনের মধ্যে শক্তি জুগিয়েছি যে আমরা ফিরবো, আমাদের দেশ স্বাধীন হবে।

এরপর আমরা দিল্লীতে যাই। তখন পূজার সময়। দিল্লীতে পূজা মন্ডপগুলোতে প্রচুর গান করলাম। পয়সা কড়ি যা পেলাম তা সংগঠনে দেয়া হলো। সেই অর্থ দিয়ে সংগঠন থেকে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প, শরণার্থী ক্যাম্পে ট্রাকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাঠানো হতো।

ভয়েস অফ আমেরিকা: স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়াটি কেমন ছিলো?

বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম শিল্পী সংস্থা’র শিল্পী হিসেবে প্রাপ্ত সার্টিফিকেট। (ছবি: সৌজন্য)
বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম শিল্পী সংস্থা’র শিল্পী হিসেবে প্রাপ্ত সার্টিফিকেট। (ছবি: সৌজন্য)

শাহীন সামাদ: ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শিল্পী সংস্থার’ যে মূল সংগঠন ‘বাংলাদেশ-সহায়ক শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমিতি’ তা অত্যন্ত শক্তিশালী সংগঠন ছিলো। অনেক বড় বড় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এর সাথে যুক্ত ছিলেন। তো সে কারণেই একসময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সমর দা আমাদের আমন্ত্রণ জানান। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছোট্ট একটা জায়গা। সেখানে আমি রথীন্দ্রনাথকে, জব্বার ভাইকে দেখেছি। সুজেয় শ্যাম দা এবং কাদেরী কিবরিয়াকে দেখেছি। তাঁরাই কয়েকজন থাকতেন। বাকিরা বাইরে থেকে এসে গান করতেন। আমরা সেখানে আট থেকে দশ জনের একটি দল যাই। সে সময় আটটি গান আমাদের দিয়ে রেকর্ড করানো হয়। সেগুলো তো সবসময়ই বেজেছে। এরপর যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে আবার আমাদের ডাকলেন। সে সময় আমরা মুক্তাঞ্চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম অর্থাৎ যশোরে যাবো। কিন্তু এখানে গান দরকার। তাই আমরা টালিগঞ্জ স্টুডিও থেকে চৌদ্দটি গান রেকর্ড করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে জমা দিয়ে আসি। সেই গানগুলোই চব্বিশ ঘন্টা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বাজতো। এ গানগুলো আমি পরবর্তী সময়ে আমার ছায়ানটের শিক্ষার্থীদের শিখিয়েছি। এখনো ছায়ানটে গানগুলো শেখাচ্ছি।

ভয়েস অফ আমেরিকা: সে সময়ের কয়েকটি গানের চরণ যদি শোনাতেন?

শাহীন সামাদ: তখনকার উল্লেখযোগ্য গানগুলো হলো, ‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক আমি তোমায় ছাড়ব না’, ‘কারার ওই লৌহ কপাট’, ‘মানুষ হ মানুষ হ’, ‘পাক পশুদের মারতে হবে, ‘শোনেন শোনেন ভাইসব’, ‘এই না বাংলাদেশের গান’, ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই’, ‘এসো মুক্তিগানের সাথী’, ‘চল যাই চল যাই’, ‘শিকল পরার ছল’, ‘স্বাধীন স্বাধীন দিকে দিকে’ এরকম আরো অনেক গান।

ভয়েস অফ আমেরিকা: মুক্তিযুদ্ধের সময়কার যে গানগুলো তখন লেখা হয়েছিলো, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারিত হয়েছিলো সে সব গান কি সঠিক ভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে?

শাহীন সামাদ: এইসব কালজয়ী গানগুলো কিন্তু হারিয়ে যাবে। শিল্পীরাও অনেকেই চলে গেছেন। করোনার সময়েও অনেক শিল্পীদের আমরা হারিয়েছি। কিছুদিন আগে আমি এক টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠানে গিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আ.ক.ম. মোজাম্মেল হক ভাইকে বলেছি, গানগুলো সব হারিয়ে যাচ্ছে, শিল্পীরা হারিয়ে যাচ্ছেন। এগুলো হারিয়ে গেলে আমাদের তরুণ প্রজন্ম কিছুই জানতে পারবে না। তাদের কন্ঠে কে এই গানগুলো তুলে দেবে? তাই এখনও যেসব শিল্পীরা বেঁচে আছেন, তাদের দিয়ে গানগুলো করিয়ে ফেলেন। আমি চাই গণমাধ্যমও এ গানগুলো শিশুদের শেখানো, শিশুদের দিয়ে গাওয়ানোর বা এ প্রজন্মের শিল্পীদের দিয়ে গাওয়ানোর ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিক।

তিন-চার বছর আমি, অজয় দা ও সুজেয় দা বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে ভাগ করে নিয়ে এ গানগুলো শেখাতাম। সারা বাংলাদেশ থেকে প্রায় তিনশ জনের মতো গানের শিক্ষার্থীরা আসতো। এক মাস এ কার্যক্রম চলতো। আমরা তিনজন ভাগ করে নিয়ে প্রত্যেকে কয়েকটা করে গানগুলো তাদের শেখাতাম। এভাবে করে ওরা অনেক গান তুলেছিলো। কিন্তু হঠাৎ করেই সেই কার্যক্রম একদিন বন্ধ হয়ে গেলো। আমি মনে করি, এ কার্যক্রমটি আবার চালু হলে ভালো হতো।

ভয়েস অফ আমেরিকা: মাত্র ১৮ বছর বয়সে একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। শরণার্থী শিবির, রণাঙ্গনের নানা প্রান্তে ছুটে বেরিয়েছেন। অর্থ সংগ্রহে ভারতে প্রচুর অনুষ্ঠান করেছেন, গান গেয়েছেন । যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে এসেছেন। এখন সেইসব স্মৃতি মনে করলে কেমন লাগে?

শিল্পী শাহীন সামাদ। (সৌজন্য ছবি)
শিল্পী শাহীন সামাদ। (সৌজন্য ছবি)

শাহীন সামাদ: আমি প্রয়াত চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ যে তিনি ‘মুক্তির গান’ নির্মাণ করেছিলেন। কারণ আমরা তো এর আগে কাউকে জানাইনি যে আমরা একাত্তরে কন্ঠযোদ্ধা হিসেবে এই কাজগুলো করেছি। ‘মুক্তির গান’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে কোটি কোটি মানুষ জানলো। আমাদের তখন স্টেজে উঠতে হলো। সবাই আমাদের ছুঁয়ে দেখতো, জড়িয়ে ধরতো, কাঁদতো। এই যে মানুষের এত ভালোবাসা পেলাম, সেটা এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। তবে আমার আফসোস থেকে যাবে, আমার আম্মা ‘মুক্তির গান’ দেখে যেতে পারেননি। তার আগেই তিনি মারা গেছেন। দেখে যেতে পারলে তিনি আমাকে নিয়ে আরো গর্ব করতে পারতেন। আমি এখনও গান গেয়ে যাচ্ছি। আমার জায়গা থেকে চেষ্টা করছি স্বাধীনতার গানগুলোকে তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে। বাংলাদেশ সরকার এখন আমাকে যে স্মার্ট কার্ড (জাতীয় পরিচয়পত্র) দিয়েছেন তাতে লেখা বীর মুক্তিযোদ্ধা। এখন আর কন্ঠযোদ্ধা বা কন্ঠসৈনিক বলা হয় না।

XS
SM
MD
LG