উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে পথচলার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের বছরে বৈশ্বিক মহামারীর প্রতিঘাত এবং যুদ্ধের কারণে চলমান ৭৬টি প্রজেক্ট নিয়ে বেশ চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছে বাংলাদেশ ও জাপান। জাপানি অর্থায়ন কিংবা সহায়তায় চলমান থাকা বেশ কিছু প্রজেক্টের ব্যয় এবং সময় বাড়ানোর খবর ইতিমধ্যে গণমাধ্যমে এসেছে। কিছু প্রজেক্টের কাজ আবার প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম শেষ হয়েছে। তবে দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব শরিফা খান ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানিয়েছেন, বিভিন্ন ধরনের সংকট কাটতে থাকায় অধিকাংশ প্রজেক্টের কাজ পুরোদমে চলছে।
ইআরডি’র আমেরিকা এবং জাপান শাখার যুগ্ম সচিব এ কে এম সোহেলের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এখন লোনের প্রজেক্ট চলছে ২৮টি। আর শুধু জাপানি অর্থায়নে ১২টি। টেকনিক্যাল কোঅপারেশনের প্রজেক্ট ৩৬টি। এই ৩৬টি প্রজেক্টের মধ্যে জাপান সরকারের অর্থ যেমন আছে, তেমনি বাংলাদেশ সরকারের অর্থও আছে। বিভিন্ন মেয়াদের প্রজেক্টগুলোর ন্যূনতম সময়সীমা তিন বছরের উপরে।
বাংলাদেশে উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে জাপানের পথচলা শুরু হয় ১৯৭৩ সালের মার্চে। এই মার্চে ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করতে জাপান একটি ম্যাগাজিন তৈরি করেছে। সেই ম্যাগাজিনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সাল পর্যন্ত জাপান বাংলাদেশকে ৯৬ হাজার ৪৬ মিলিয়ন ইয়েনের কারিগরি সহায়তা দিয়েছে। পাশাপাশি আনুষ্ঠানিক উন্নয়ন সহযোগিতা (ওডিএ) কর্মসূচির আওতায় দেশটি দিয়েছে ২,৩৯৫.২৮২ বিলিয়ন ইয়েন। এই সময়ে অনুদান সাহায্য এসেছে ১৩৯,০৮৪ মিলিয়ন ইয়েন।
এই ৫০ বছরে প্রশিক্ষণার্থী এবং বিদেশি শিক্ষার্থী এসেছেন ১৩ হাজার ৮৬৬ জন। দেশটির বিদেশি সহযোগিতা সেচ্ছাসেবী এসেছেন এক হাজার ২৮৪ জন। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) থেকে বিশেষজ্ঞ এসেছেন চার হাজার ৯২১ জন।
দেশটির আগ্রহ যেখানে
বাংলাদেশে অন্তত নয়টি খাতে কাজ করছে জাপান। এক. বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, দুই. পরিবহন, তিন. নগর উন্নয়ন, চার. সুশাসন, পাঁচ. স্বাস্থ্য, ছয়. শিক্ষা, সাত. কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন, আট. দুর্যোগ প্রতিরোধ ও জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধ।
এছাড়া বেসরকারি খাতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় ওয়ান-স্টপ সেবা প্রচলনের পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি প্রকৌশল পরীক্ষার (ITEE) প্রচলন করতে সহায়তা দিয়েছে দেশটি।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি: জাইকার দাবি, তারা বাংলাদেশে গত ৫০ বছরে ২ হাজার ৪৩৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি করেছে, যা বাংলাদেশের মোট সক্ষমতার ১২ শতাংশ। এছাড়া ২৫ হাজার কিলোমিটারের বেশি বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন নির্মাণ ও সংস্কার করেছে সংস্থাটি। পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিতরণের জন্য ১০৮টি সাবস্টেশন নির্মাণ ও সম্প্রসারণ করেছে তারা।
পরিবহণ: ১৩৪টি সেতু তৈরিতে সহায়তা করেছে জাইকা। যার মধ্যে ছয়টি সেতুর দৈর্ঘ্য ৫০০ মিটারের বেশি (যেমন যমুনা, পাকসী, রূপসা, গোমতী, মেঘনা ও কালনা সেতু)। তিনটি ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট বা এমআরটি প্রকল্প (লাইন ৬. লাইন ১, এবং লাইন ৫ নর্থ) তৈরি করছে সংস্থাটি। যার মাধ্যমে ২০ লাখ যাত্রী দৈনিক যাতায়াত করতে পারবে। এমআরটি লাইন ৬ শেষ হলে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত যাতায়াতের সময় ১০৫ মিনিট থেকে কমে ৩৬ মিনিট হবে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিমানবন্দর অবকাঠামো নির্মাণ, যেখানে দৈনিক মোট ১৪ মিলিয়ন যাত্রী যাতায়াত করবে।
নগর উন্নয়ন: ঢাকার পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতিতে জাপান সহায়তা দিয়েছে।
দুর্যোগ প্রতিরোধ/জলবায়ু পরিবর্তন: প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি কমাতে সারাদেশে পাঁচটি আবহাওয়া রাডার স্থাপনে সহায়তা দিয়েছে জাইকা। ১১৭টি উচ্চ মানসম্পন্ন ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করেছে তারা। এছাড়া জাইকার সহায়তায় বন্যা প্রতিরোধে ২৪০ কিলোমিটার নদীর বাঁধ নির্মিত হয়েছে।
কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন: ৪৮৯ জন বিশেষজ্ঞের কারিগরি নির্দেশনার মাধ্যমে ধান উৎপাদনের হার বাড়াতে সাহায্য করেছে জাপান এবং অংশগ্রহণমূলক গ্রামীণ উন্নয়নের (লিংক মডেল) প্রচলন করে ২১৫টি উপজেলায় কাজ করেছে দেশটি।
শিক্ষা: জাপানে প্রস্তুতকৃত Lesson study ছড়িয়ে দিতে নানামুখী পদক্ষেপের কথা কিছুদিন আগেও গণমাধ্যমে এসেছে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে তাদের সহায়তায় অনুসন্ধানভিত্তিক ও সমস্যা সমাধানভিত্তিক পাঠদান উন্নয়নে পাঠ্যবই পরিমার্জন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য এখন পর্যন্ত ৬০ হাজার বিদ্যালয় পরিমার্জিত পাঠ্যবই পেয়েছে।
স্বাস্থ্য: জাপান ২০৫ জন JOCV পাঠিয়ে পোলিও এবং ফিল্যারিয়া নির্মূলে সাহায্য করেছে। এছাড়া ২.৫ মিলিয়ন মানুষের জন্য ৪১৭টি কমিউনিটি স্বাস্থ্য ক্লিনিক নির্মাণে ভূমিকা রেখেছে জাইকা। ‘নরসিংদী মডেল’ দেশব্যাপী প্রতিষ্ঠা ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি হয়েছে।
সুশাসন: ৪৯২টি উপজেলায় অংশগ্রহণমূলক উন্নয়নের মাধ্যমে ছোট আকারের অবকাঠামোর প্রচলন করেছে দেশটি। ৬৪টি জেলায় মৎস্য, পশুসম্পদ, কৃষি সেচ, স্বাস্থ্য ও কল্যাণ এবং শিক্ষার মতো বিভিন্ন সেক্টরে ২৮০০টিরও বেশি অংশগ্রহণমূলক প্রকল্পে কাজ করেছে দেশটি।
ব্যবসায়ীরা নতুন আশায়
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রস্তুত হলে জাপানভিত্তিক কোম্পানি ও যৌথ উদ্যোগের প্রত্যাশায় নতুন দিনের স্বপ্ন দেখছেন দেশের ব্যবসায়ীরা। তাদের আশা, এই অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘিরে জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ইতিহাস নতুন মাত্রা পাবে।
জাপান-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (জেবিসিসিআই) সাবেক জেনারেল সেক্রেটারি তারেক রাফি ভুঁইয়া এ বিষয়ে ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, ‘‘নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে ইকনোমিক জোন আমাদের প্রধানমন্ত্রী ডিসেম্বরের ৬ তারিখ উদ্বোধন করেছেন। জাপানি প্রতিষ্ঠান এর ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে থাকায় তাদের অনেক কোম্পানি ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট করার জন্য আগ্রহ দেখাচ্ছে। জাপানের সঙ্গে ব্যবসায়িক খাতে এটা নতুন মাত্রা যোগ করবে।’’
জেবিসিসিআই’র এই সদস্য বলেন, ‘‘বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগের অবস্থা এখন বেশ ভালো। তাদের অনেকগুলো প্রজেক্ট বাংলাদেশে চলছে। প্রজেক্টগুলো ভালো করায় অনেক কোম্পানি বিনিয়োগ করছে। বাংলাদেশের জিডিপি এখন ভারতের চেয়ে ভালো আর সার্বিকভাবে ভিয়েতনামের চেয়েও বড় হয়েছে। তাই বাংলাদেশের মার্কেট ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। একারণে জাপানের অনেক কনজিউমার এবং সার্ভিস কোম্পানি বিনিয়োগ করছে।’’
আরও বিনিয়োগের আহ্বান
‘রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা’ এবং ভৌগলিক কারণে বাংলাদেশ সব সময় জাপানের সঙ্গে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সম্প্রতি জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশনের (জেবিআইসি) গভর্নর নবুমিতশু হায়াশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করলে তিনি বৃহত্তর বিনিয়োগের আহ্বান জানান। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার এম নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের একথা জানান।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও সম্প্রতি একই ধরনের আহ্বান জানিয়েছেন। গত ২৯ জানুয়ারি সচিবালয়ে ঢাকায় নবনিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত আইওয়ামা কিমিনোরির সঙ্গে মতবিনিময়কালে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘জাপানের কাছ থেকে বাংলাদেশ আরও বড় ধরনের বিনিয়োগ আশা করে।’’
যেসব প্রকল্প নিয়ে চিন্তা
গত জানুয়ারির শেষ দিকে জাইকা একটি প্রতিবেদনে জানায়, তাদের অর্থায়ন করা ২৯টি প্রকল্পের মধ্যে ১৫টির বাস্তবায়ন লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক পিছিয়ে পড়েছে। জাইকার বাংলাদেশ অফিস জানুয়ারির ২২ তারিখ ঢাকাকে বিষয়টি অবহিত করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদনে দেরি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে হিসাব খুলতে দেরি হওয়ার কারণে ৯ মাসেও কোনো উন্নতি হয়নি আরবান ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সিটি গভর্নেন্স প্রজেক্টের। এ প্রকল্পের জন্য জাইকা ২০২২ অর্থবছর (২০২২ এপ্রিল- ২০২৩ মার্চ) মেয়াদে ১০২ কোটি ইয়েন (৮২ কোটি টাকার বেশি) বরাদ্দ করেছে। একইভাবে হেলথ সার্ভিসেস স্টেনথেনিং প্রজেক্ট এবং ফুড ভ্যালু চেইন ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টে অগ্রগতি না হাওয়ার কথা জানায় দেশটি।
কাজে অগ্রগতি না হওয়ার জন্য জাইকা তাদের প্রতিবেদনে কিছু কারণের কথা উল্লেখ করেছিল: ভূমি অধিগ্রহণে বিলম্ব, অনুমোদন প্রক্রিয়া, বিডিং এবং রিবিডিং নথি প্রস্তুত করা। ক্রয়ে ধীরগতি এবং কিছু সিভিল কাজের জন্যেও অনেক প্রকল্পের কাজ পিছিয়ে গেছে বলে উল্লেখ করে তারা।
মেগাপ্রকল্পগুলোর অবস্থা
চলতি বছরে কক্সবাজারের মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর উদ্বোধন হওয়ার প্রত্যাশা ছিল সংশ্লিষ্টদের। তবে শেষ পর্যন্ত বন্দরটির নির্মাণকাজ শেষের অনুমিত সময় ধরা হয়েছে ২০২৬ সাল। ১২ ফেব্রুয়ারি সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য কাজিম উদ্দিন আহম্মেদের প্রশ্নের জবাবে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জানিয়েছেন, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম ২০২৬ সালে চালু করা যাবে। তিনি বলেন, ‘‘বর্তমানে ড্রইং ডিজাইন করে কাজ শেষ করা হয়েছে। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য ৩৫০ মিটার প্রশস্ত ও ১৬ মিটার গভীরতা শেষ করে ১৪.৩০ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ চ্যানেলের নির্মাণ করা হয়েছে। অ্যাপ্রোচ চ্যানেলের উত্তর পাশে ২ হাজার ১৫০ মিটার দীর্ঘ ও দক্ষিণ পাশে ৬৭০ মিটার ঢেউ নিরোধক বাঁধ নির্মাণের কাজ সমাপ্ত হয়েছে।’’
শাহজালালে তৃতীয় টার্মিনাল: ৭ ফেব্রুয়ারি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, এ বছরের অক্টোবরেই দেশের প্রধান বিমানবন্দর ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল চালু হবে। ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের উদ্বোধন হয়। প্রকল্পের আওতায় একটি প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল বিল্ডিং, রাস্তা, কার পার্কিং, কার্গো কমপ্লেক্স, পার্কিং অ্যাপ্রোনসহ আরও অন্যান্য স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে।
মেট্রো ও পাতাল রেল: ঢাকায় গণপরিবহনের যাতায়াত উন্নয়নে গৃহীত মাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) প্রকল্প ২০৩০ সালের মধ্যে শেষ করতে চায় সরকার। মেট্রোরেল আংশিকভাবে চালু হয়েছে। ইতিমধ্যে পাতাল রেলের কাজের উদ্বোধন করা হয়েছে। ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ব্যয়ে এই পাতাল মেট্রোরেল রূপগঞ্জের পীতলগঞ্জ থেকে শুরু হয়ে জোয়ারসাহারার নতুনবাজারে যুক্ত হবে কমলাপুর-বিমানবন্দর মেট্রোরেল রুটের সঙ্গে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলসেতু: উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বারে যমুনা নদীর বুকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। মোট ৫০টি পিলারের ওপর বসানো হবে ৪৯টি স্প্যান। ইতিমধ্যে ৩৫ নম্বর থেকে ৫০ নম্বর পিলারের কাজ শেষ করেছেন প্রকৌশলীরা।