অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

ভি ডে – যে দিন প্রেমের দিন আর প্রতিরোধেরও


ভি ডে – যে দিন প্রেমের দিন আর প্রতিরোধেরও। (প্রতীকী ছবি)
ভি ডে – যে দিন প্রেমের দিন আর প্রতিরোধেরও। (প্রতীকী ছবি)

ভালোবাসা উদ্‌যাপনের দিন ১৪ ফেব্রুয়ারি, ভ্যালেন্টাইনস্‌ ডে। এক সুন্দর দিন। কিন্তু ভালোবাসার আড়ালে, সুরক্ষা দেওয়ার নামে যখন মেয়েদের উপর চলতে থাকে হিংসা, বৈষম্য তখন এই দিনই হয়ে ওঠে প্রতিরোধের। পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন বয়সের, পরিচিতির মেয়েরা আওয়াজ তোলেন ‘ওয়ান বিলিয়ন রাইজিং’।

ভালোবাসা – এক চিরন্তন অনুভূতি। প্রেমের অভিব্যক্তি থাকে, ভালোবাসার উদ্‌যাপন থাকে।সেই উদযাপনের সুনির্দিষ্ট দিন থাকে। যেমন ১৪ই ফেব্রুয়ারি, সারা পৃথিবী যেদিন মেতে ওঠে ভ্যালেন্টাইন’স ডে বা ভালোবাসার দিনে প্রিয় মানুষটিকে ভালবাসার কথা জানাতে।কিন্তু বহুক্ষেত্রেই ভালোবাসার সম্পর্কের নিগড়ে ঘাপটি মেরে থাকে পুরুষতন্ত্র।অর্থাৎ, সম্পর্কের মধ্যে নারীর ভূমিকা লঘু হয়ে যায়। বিপরীত লিঙ্গের প্রেমে নারী-পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে ঢুকে পড়ে যৌন নিপীড়ন, গার্হস্থ্য হিংসা।

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো(এনসিআরবি)-র তথ্য অনুসারে, ভারতে ২০২১ সালে মহিলাদের বিরুদ্ধে মোট ৪২,৮২৭৮টি অপরাধ ঘটেছে।এর মধ্যে স্বামীর দ্বারা স্ত্রীর অত্যাচারিত হওয়ার ঘটনার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, মোট অপরাধের ৩২ শতাংশ।আবার, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো জানাচ্ছে যে, বাংলাদেশে ২০২০ সাল জুড়ে বিবাহিত নারীদের মধ্যে ৫৪.২% তার সঙ্গী দ্বারা যৌন ও শারীরিক হিংসার সম্মুখীন হয়েছে।অর্থাৎ ভালোবাসাকে ভর করে যে সহাবস্থান হওয়ার কথা সেখানেও মহিলারা সুরক্ষিত নন। অন্যদিকে মেয়েদের আর্থ-সামাজিক বা রাজনৈতিক অবস্থানের ছবিটাও মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। ২০২২-এর জুলাই-এ প্রকাশিত ‘শিকাগো পলিসি রিভিউ’-এর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৪০% নারী যৌন হিংসার সম্মুখীন হয়েছেন।তার মধ্যে প্রায় ৮০% মহিলা ২৫ বছর বয়সের আগেই প্রথম যৌন হিংসার শিকার।

“গার্হস্থ্য হিংসার বড় কারণ অল্প বয়সের শিক্ষা”, এমনটাই দাবি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতা নিবাসী অধ্যাপক ও সংখ্যালঘু মহিলাদের অধিকার আন্দোলনের কর্মী আফরোজা খাতুনের। তাঁর কথায়, “জন্মসূত্রে একটি ছেলে জানছে যে সবকিছু পাওয়ার অধিকার তার, শাসন করার অধিকারও তারই। সে জায়গায় জন্ম থেকেই একটি মেয়ে শিখছে তার এক ও একমাত্র কাজ পুরুষকে পরিষেবা দেওয়ার। তাই, একজন নারীর, লিঙ্গ পরিচয়ের বাইরে নিজেকে প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই চলে আজন্ম।” আবার, ভারতের বেঙ্গালুরু শহরের কর্পোরেট সংস্থায় কর্মরত পায়েল তিওয়ারির কথায়- “আইনের তোয়াক্কা না করে এখনও বহু দেশে একটি ভ্রূণের লিঙ্গ ঠিক করে দেয় সে আদৌ এই পৃথিবীর জল-হাওয়া পাবে কিনা।এমনকি, জন্মের পরেও তার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মক্ষেত্রে শ্রমের মূল্য, মাতৃকালীন সুবিধা – সবই নির্ধারণ করে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো।” তিনি আক্ষেপ করে আরো বলছেন যে, “চাকরি করার পরেও, পারিবারিক ক্ষেত্রে কখনো বা অফিসে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে মেয়েদের ছোট করে দেখা হয়।” ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার রাখি ঘোষ গৃহ পরিচারিকার কার কাজ করে সংসার টানেন। তিনিও জানাচ্ছেন যে, “রোজগার করলেও, সংসারের হাল ধরলেও, নিত্যদিনের জীবনে থাকে অপমান আর যৌন হয়রানি, থাকে ধর্ষণের ভয়।”

জাতিসংঘ-র তথ্য অনুযায়ী লিঙ্গভিত্তিক হিংসা বর্তমান পৃথিবীতে মহামারীর আকার নিয়েছে।কোভিড মহামারীর চোখরাঙানি আর নেই ঠিকই। কিন্তু, এনসিআরবি-র তথ্য বলছে ভারতে কোভিডকালীন পরিস্থিতিতেও মেয়েদের বিরুদ্ধে হিংসার ঘটনা বেড়েছে প্রায় ১৫%। এই তথ্য প্রমাণ করে, একটি মেয়ের কাছে তার নিজের বাড়ি কতটা অসুরক্ষিত। কোভিড মহামারীতে জীবন-জীবিকার ক্ষতির সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে মহিলাদের ওপর। মহিলাদের সুরক্ষার বিষয়টি নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে কোভিড পরিস্থিতি।

অন্যদিকে, কয়েক মাস আগেই সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়ে উঠেছিল ইরানে হিজাব বিতর্কে মাহশা আমিনি-র মৃত্যু। সে দেশের নীতিপুলিশ (Moral police) তাকে গ্রেফতার করেছিল ‘অনুচিত’ পোশাকের জন্য। ইরানের মতো অনেক দেশেই নারীর পোশাক, তার খাদ্যাভ্যাস, পাঠাভ্যাস সবই ঠিক করে দেয় সমাজের পুরুষতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। এবং পুরুষতন্ত্র নির্ধারিত পোশাক না পরার অপরাধে লকআপ-এ অত্যাচার করে একটি মেয়ের জীবন শেষ করেও দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে যায়। এই প্রসঙ্গেই আফরোজা খাতুন জানাচ্ছেন, “পিতৃতান্ত্রিকতা সব ধর্মে আছে, সমাজ নির্মাণের মধ্যে আছে, রাষ্ট্র ব্যবস্থাতেও আছে। মেয়েরা কী পোষাক পড়বে তা, কখনো রাষ্ট্র ঠিক করে দিচ্ছে, কোথাও বা ধর্ম ঠিক করে দিচ্ছে। বিশ্বের কোথাও কোথাও ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি মিশে যে সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে তার অন্যতম কাজই হল মেয়েদের দমন করা।” তিনি আরো জানাচ্ছেন যে, “এই সমাজ ব্যবস্থায় লিঙ্গভিত্তিক হিংসার জন্য অভিযোগ ওঠে একটি মেয়ের দিকেই।”

জাতিসংঘ-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বজুড়ে প্রতি তিনজন মহিলার মধ্যে অন্তত একজন ধর্ষণ, শারীরিক হিংসার মতো লিঙ্গভিত্তিক হিংসার শিকার হন। এই বিষয়কে মাথায় রেখেই, ‘ভ্যাজাইনা মোনোলগ’ বইয়ের লেখক ইভ এন্সলার যিনি এখন ‘ভি’ নামে পরিচিত, ২০১২ সালে আমেরিকায় শুরু করেন ‘ওয়ান বিলিয়ন রাইজিং’ ক্যাম্পেন। ১৪ ফেব্রুয়ারিকে তিনি বেছে নিলেন ‘ভি ডে’ হিসেবে। সারা পৃথিবীর মেয়েদের ডাক দিলেন বেরিয়ে আসার, নিজেদের অধিকারের জন্য উঠে দাঁড়ানোর। এ বেরিয়ে আসা শুধুমাত্র বাড়ির বাইরে বা কাজের বাইরে আসা নয়, বরং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আগল ভেঙে বেরোনোর দ্যোতনা হয়ে উঠল। এই ক্যাম্পেন-এ লিঙ্গভিত্তিক হিংসা প্রতিরোধের উদযাপন করা হয় বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমের মধ্যে দিয়ে।

পৃথিবীর প্রায় ১৭০টি দেশে ‘ওয়ান বিলিয়ন রাইজিং,’ লিঙ্গ সচেতনতা গড়ে তোলার কাজে নিয়োজিত সমমনস্ক সংগঠনগুলির সঙ্গে বছরভর কাজ করে। এইসব সংগঠনগুলিও ‘ওয়ান বিলিয়ন রাইজিং’-এ সংহতি জানিয়ে ১৪ই ফেব্রুয়ারি দিনটি প্রেম ও প্রতিরোধের দিন হিসেবে পালন করে। । ভারত, বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে সারা পৃথিবীর সঙ্গে উদযাপিত হয় ‘ওয়ান বিলিয়ন রাইজিং’। ২০২৩-এ এই দিনটি পালিত হবে ‘রাইজিং ফর ফ্রিডম’-এর উদ্দেশ্যে যার অর্থ লিঙ্গভিত্তিক হিংসা, লিঙ্গ অসাম্য বন্ধ করতে পারা যেখানে পিতৃতন্ত্র, সাম্প্রদায়িকতা, অর্থনৈতিক বৈষম্যকে ভেঙে ফেলা যায়। এইভাবেই ভালোবাসার দিনে, বৈষম্যহীন ভালোবাসার হাত ধরে প্রতিরোধের সুরে বেজে ওঠে মেয়েদের শিকল ভাঙার জয়গান।

XS
SM
MD
LG