অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

বাংলা উপন্যাসে প্রেম ও দ্রোহে নারী


বাংলা উপন্যাসে প্রেম ও দ্রোহে নারী। (ছবি: অ্যাডোবি স্টক)
বাংলা উপন্যাসে প্রেম ও দ্রোহে নারী। (ছবি: অ্যাডোবি স্টক)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসের অমিত রায়, লাবন্যকে প্রথম দেখার পরে বাড়ি ফিরে এসে কবিতার খাতা বের করে লিখেছিলো, “পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি / আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী।” লাবন্যকে দেখার পর অমিতের মানসপটে যে আলোড়নের বর্ণনা রবি ঠাকুর দিয়েছেন তা যেনো বাঙালি তরুণের মনে হাজার বছর ধরে লালিত প্রেমের আখ্যান। বাংলা সাহিত্যে প্রেম এসেছে বহু রঙে-বর্ণে, বিভিন্ন আঙ্গিকে। হাজার বছর ধরে সাহিত্যে প্রেম ও বিরহ একই মুদ্রার দুই পিঠ। বাংলা সাহিত্যকে পাঠকের কাছে চিরন্তন করেছে প্রেম, বিরহ ও মিলন কেন্দ্রিক সাহিত্য। বাংলা উপন্যাসে সবচেয়ে বৈচিত্রপূর্ণ বিন্যাস করা হয় নারী চরিত্রগুলোকে। সাহিত্যিকরা উপন্যাসে নারীদের বহু রঙে একেঁছেন। কখনো সে একেবারে শ্বাশত বাঙালি নারী। কখনও বা প্রথা ভাঙা, সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখানো প্রতিবাদী চরিত্র। কখনও প্রেমময়, কখনও কঠোর।

বাংলা উপন্যাসে প্রেম ও প্রেমিকা

বাংলা সাহিত্যের শুরুতেই আসে চর্যাপদের কথা। দেড় হাজার বছর আগে রচিত চর্যাপদের পংক্তিতেও প্রেম ও নারীকে নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রাচীন ২৮ নং চর্যার কয়েকটি পংক্তির বাংলা করলে প্রেম ও নারীর যে সুস্পষ্ট বর্ণনা পাওয়া যায় তা হল; ‘উঁচু উঁচু পাহাড়ে শবরী বালিকা বাস করে। তার মাথায় ময়ূরপুচ্ছ ও গলায় গঞ্জরীমালা লাগানো আছে। নানা তরু মুকুলিত হলো। তাদের শাখা-প্রশাখা আকাশে বিস্তৃত হলো। শবর-শবরী প্রেমে পাগল হলো। তাদের হৃদয় রঙিন ও উদ্দাম হলো কামনার রঙে। অতঃপর শয্যা পাতা হলো। শবর-শবরী প্রেমাবেশে রাতযাপন করল।’

আবার মঙ্গলকাব্য সাহিত্যে প্রেমের উপস্থাপনের পাশাপাশি নারীর উপস্থিতি ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও প্রাধান্য পেয়েছে। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী চন্ডীমঙ্গল কাব্যে মূলত কালকেতু ও তার স্ত্রী ফুল্লরার প্রতি দেবী চন্ডীর অনুগ্রহের কাহিনী বর্ণনা করেছেন। এ কাব্যে দেবীর সরব উপস্থিতি ও ফুল্লরার স্বামীর প্রতি ভালবাসা, প্রেম, প্রতিবাদ, বিশ্বাসের পরীক্ষা ফুল্লরাকে মুখ্য চরিত্রে (প্রটাগনিস্ট) পরিণত করেছে। এক্ষেত্রে মনসামঙ্গল কাব্যের বেহুলা ও লখিন্দরের প্রেমও বিশেষভাবে উল্লেখ্য। মনসার শাপে সাপ দংশন করে চাঁদ সওদাগরের পুত্র লখিন্দরকে । তাকে প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী ভেলায় করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। সব বাধা উপেক্ষা করে লখিন্দরের স্ত্রী বেহুলা স্বামীর সঙ্গে ভেলায় সহযাত্রী হয়। স্বামীর প্রতি অগাধ প্রেম ও তাকে বাঁচানোর জন্যে বেহুলার যে আকুতি ও প্রচেষ্টা তা তাকে মূল চরিত্র হিসেবে বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন করে দিয়েছে।

অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে উপন্যাসের ধারায় আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে। এর সাথে সাথে পাল্টাতে থাকে নারী চরিত্রগুলোও। প্রেমের উপন্যাসগুলোতে বৈচিত্র্য আসে প্রেম, প্রণয় ও বিরহের চিত্রণে। বাংলা সাহিত্যের খ্যাতনামা ঔপন্যাসিকদের লেখনিতে এক একটি অমর চরিত্রের সৃষ্টি হয়। এ প্রসঙ্গে আমরা কথা বলেছিলাম দুই বাংলার কয়েকজন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিকদের সঙ্গে। তাঁরা ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানিয়েছেন, কিভাবে তাঁরা বাংলা প্রেমের উপন্যাস এবং উপন্যাসের নারী চরিত্রকে মূল্যায়ন করছেন। জানিয়েছেন বাংলা উপন্যাসে তাঁদের প্রিয় নারী চরিত্রগুলোর কথা।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

কিন্তু সামগ্রিক বিষয়টা তো হলো নারী ও পুরুষের মধ্যে একটা আকর্ষণ যা সৃষ্টির আদিকাল থেকে চলে আসছে। তাই নারী লিখুন আর পুরুষই লিখুন প্রেমের ব্যাপারটা অগ্রাধিকার পাবে।

বেশিরভাগ উপন্যাস লিখেছেন পুরুষ সাহিত্যিকরা। বঙ্কিমের আমল থেকে এ আমল পর্যন্ত লেখিকার চেয়ে লেখকের সংখ্যা অনেক বেশি। সে কারণেই সাহিত্যে বেশিরভাগ নারীদের দেখা হয়েছে পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে। কাজেই মনে হতে পারে যে শুধু প্রেমিকা হিসেবে দেখা হয়েছে। আর বিভিন্ন সময়ে নারীরা যারা লিখেছেন তাদের লেখায় হয়তো প্রেম আছে তবে সেই দৃষ্টিভঙ্গিটা পুরুষদের মতো নয়। নারীর অসহায়ত্বটাই হয়তো বেশি ফুটেছে। কিন্তু সামগ্রিক বিষয়টা তো হলো নারী ও পুরুষের মধ্যে একটা আকর্ষণ যা সৃষ্টির আদিকাল থেকে চলে আসছে। তাই নারী লিখুন আর পুরুষই লিখুন প্রেমের ব্যাপারটা অগ্রাধিকার পাবে। পুরুষ লেখকের চোখে নারী বেশি রোমান্টিক। তার দৃষ্টিতে সৌন্দর্য অনেক বেশি আরোপিত হয়ে যায়। সৌন্দর্য প্রেমের প্রথম শর্ত। খুব সুন্দরী না হলেও প্রেমিকের বর্ণনায় সে সুন্দর। যেমন লায়লা-মজনুর লায়লা কিন্তু খুব সুন্দরী ছিলেন না। কিন্তু তবু মজনু তাকে ভালোবেসেছিলেন। এবং মজনু বলেছিলেন যে, লায়লাকে দেখতে হলে মজনুর চোখ দিয়ে দেখতে হবে। এই দেখাটাই আরোপিত। প্রেমের উপন্যাসে সামাজিক বিষয়গুলো যেমন বিধি-নিষেধ, শাসন ইত্যাদি চলে আসে কারণ তা সম্পর্কিত। তবে সবকিছু ছাড়িয়ে বিভূতিভূষণ, রবীন্দ্রনাথ এবং পরবর্তী সময়ের লেখকদের লেখায় প্রেমটাই প্রাধান্য পেয়েছে। প্রেমিকা চরিত্র বা মুখ্য নারী চরিত্র হিসেবে অনেকগুলো প্রিয় চরিত্রের মধ্যে এই মূহূর্তে মনে পড়ছে শরৎচন্দ্রের দত্তার বিজয়ার কথা। এছাড়া বঙ্কিমচন্দ্রের রোহিনী, দুর্গেশনন্দিনীর কুন্দনন্দিনী, আয়েশা; রবীন্দ্রনাথের লাবন্য এই চরিত্রগুলো আমার ভালো লাগে।

বাণী বসু

এখনকার উপন্যাসে অন্যান্য বিষয়ের সাথে প্রেম আছে, শারীরিক সম্পর্ক আছে, তবে প্রেমের সেই আকুতি দেখা যায় না।

কথাসাহিত্যের একেবারে গোড়ার দিকে পুরুষ লেখকরা নারীদের জন্য যে মাপকাঠি সৃষ্টি করেছিলেন সে অনুযায়ী তারা চরিত্রগুলো সৃষ্টি করতেন। তার মধ্যে ছিলো নারীর শারীরিক সৌন্দর্য, নারীর রহস্যময় রূপ। আর ছিলো তার কতগুলো কাজকর্ম যেগুলো নারী মানেই করতে হবে। সেগুলোর মধ্যে চরিত্রগুলো ঘোরাফেরা করতো। সেই জায়গায় বঙ্কিমচন্দ্রের আয়েশার মতো একটি চরিত্র বা আনন্দমঠের শান্তি বা কপালকুন্ডলা এগুলো সত্যিই খুব উল্লেখযোগ্য। বঙ্কিমচন্দ্র নিজেও সেই যুগের নারী আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। লেখক আরম্ভ করেন একটা সামাজিক অবস্থান থেকে। কিন্তু যত এগোন নিজের সৃষ্টিকর্মের মধ্যে তিনি ততই হারিয়ে যেতে থাকেন এবং সেই সত্যটা প্রকাশিত হতে থাকে। মানে চরিত্রগুলো তার নিজের মতো করে সৃষ্টি হতে থাকে। এটা সমাজ নিরীক্ষা, দর্শন ইত্যাদির কারণে হয়ে যায়। সেটা জানি বলেই এখনো আমরা সেকালের লেখকদের লেখা পড়ে অভিভূত হতে পারছি। আগে যেমন প্রেমের উপন্যাস মানে প্রেমেরই উপন্যাস। সেখানে প্রেমটাকে মুখ্য করে দেখা হতো। বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে প্রেমের সাথে অন্যান্য বিষয় চলে এসেছে। যেগুলো বাদ দিয়ে জীবনে শুধু প্রেমটা মুখ্য হতে পারে না। তাই এখনকার উপন্যাসে অন্যান্য বিষয়ের সাথে প্রেম আছে, শারীরিক সম্পর্ক আছে, তবে প্রেমের সেই আকুতি দেখা যায় না। পছন্দের চরিত্রের মধ্যে ‘শেষের কবিতা’র লাবণ্যর কথা বলব। লাবণ্য ইন্টালেকচুয়াল সেই সঙ্গে রোমান্টিকও বটে। এ সমস্ত বৈশিষ্ট্যের কারণে লাবণ্যকে একুশ শতকের নারীদের সাথে সম্পর্কিত করা যায়।

সেলিনা হোসেন

যে কিনা বিবাহ-বিচ্ছেদের পর আবার নতুন করে প্রেমে পড়ে এবং সমাজের নিন্দাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রেমিক সাব্বিরের সঙ্গে লিভ টুগেদার করে।

নারী আমার কাছে শুধু প্রাকৃতিক লিঙ্গ নয়। নারী মানুষ। মানুষের মানবাধিকার সত্যের সঙ্গে নারীর সামাজিক অবস্থান আমার কাছে বৃহত্তর সত্য। এখানে নারী-পুরুষের পার্থক্য নেই। নারী পুরুষের লিঙ্গভিত্তিক পার্থক্য আছে কিন্তু সামাজিক অবস্থানের পার্থক্য নেই। এভাবে সাহিত্যে আমি নারীকে দেখি। আমার এ পর্যন্ত প্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যা পঞ্চাশটির মতো। অনেকগুলি উপন্যাসের প্রধান চরিত্র নারী। এসব নারীর বেশিরভাগ সাহসী, সংগ্রামী, প্রেমিকা। সাহসী প্রেমিকা চরিত্র হিসেবে তাৎক্ষণিকভাবে মনে পড়ছে ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত 'পদশব্দ' উপন্যাসের নাসিমা চরিত্রটির কথা। যে কিনা বিবাহ-বিচ্ছেদের পর আবার নতুন করে প্রেমে পড়ে এবং সমাজের নিন্দাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রেমিক সাব্বিরের সঙ্গে লিভ টুগেদার করে।

ইমদাদুল হক মিলন

মোট কথা বাংলা সাহিত্যের অনেকটাই দখল করে আছে প্রেম।

আমি যেটা প্রকৃত অর্থে মনে করি, সেটা হলো, বাংলা সাহিত্য বা পৃথিবীর সাহিত্যের দিকেই যদি আমরা তাকাই সেখানে ভালো উপন্যাসগুলোর একটি প্রধান জায়গা জুড়ে থাকে নারী-পুরুষের সম্পর্কের জায়গাটি। সেখানে প্রেম একটি বড় তাৎপর্যময় ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে নায়িকা চরিত্রটির মধ্যেই আমরা সেটা লক্ষ্য করি। বাংলা সাহিত্যের খুব গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হচ্ছে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’,‘ পুতুল নাচের ইতিকথা’। সে উপন্যাসগুলোয় যেমন বাস্তবতা আছে, সমাজের নানান উত্থান-পতনের কথা আছে, পাশাপাশি প্রেম, ভলোবাসা, আবেগের কথাও ব্যাপকভাবে আছে। যদি আমরা পদ্মা নদীর মাঝিতে কপিলা এবং কুবেরের কথা বলি, সে সম্পর্কটা অত্যন্ত রোমান্টিক একটি সম্পর্ক। কপিলা কুবেরের শ্যালিকা। সেখানে এ মেয়েটি তার শ্বশুরবাড়িতে থাকে। নানারকম ভাবে অতি দারিদ্রতায় জীবন কাটে। শেষ পর্যন্ত সে কুবেরের আমন্ত্রণে তার হাতটি ধরেময়না দ্বীপে চলে যায়। সবকিছু ভেঙ্গে তছনছ করে দিয়ে। সে সমাজের কথা ভাবে না। এরকম প্রতিবাদী চরিত্র আবার সমরেশ বসুর ‘বাঘিনী’ উপন্যাসে দেখি। এ মেয়েটি প্রেমের জন্য কোনো সামাজিক বন্ধন মানেনি। সে তার সংসার, সমাজকে ত্যাগ করেছে। আমরা যদি ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’য় শশী ডাক্তার আর কুসুমের কথা বলি সে সম্পর্কটাও খুব রোমান্টিক একটি সম্পর্ক। এখানে কুসুম মেয়েটি শশী ডাক্তারের প্রতি এতোই আকৃষ্ট থাকে, কিন্তু একটা পর্যায়ে যেয়ে সে তার মুখ ফিরিয়ে নেয়। সে সিদ্ধান্ত নেয় যে স্বামীর সঙ্গে বাবার বাড়ি ফিরে গিয়ে জীবনটা কাটাবে। তারাশঙ্করের ‘কবি’ উপন্যাসটি পুরোটাই কিন্তু প্রেমের উপন্যাস এবং আমার মতে এটি তারাশঙ্করের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। এ উপন্যাসে আমরা দেখি বসন্ত যে ছিলো যাত্রাদলের মেয়ে, সে কিন্তু সমাজকে কখনো তোয়াক্কা করেনি। আবার অন্যদিকে ঠাকুরঝি সমাজকে তোয়াক্কা করতে গিয়ে পাগল হয়ে মরে গেলো প্রেমের কারণে। এই যে সমাজের বিভিন্ন রীতিকে ভেঙে প্রেমের জন্য এগিয়ে যাওয়া এরকম গল্প এখন যেমন অনেক হচ্ছে, আগেও তৈরি হয়েছে। কিন্তু তা পরিমানে খুব বেশি না।

আমি এক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের কথা যদি বলি, বিমল করের ‘খড়কুটো’ নামে একটি উপন্যাস আছে। সে উপন্যাসে অমল এবং ভ্রমর নামে দু’টি ছেলেমেয়ের সম্পর্ক দেখানো হয়, মেয়েটি ক্যান্সারে ভুগছে। সবকিছু মিলিয়ে সে উপন্যাসটি মনে দাগ কাটার মতোই। সমরেশ মজুমদারের ‘কালবেলা’ ও ‘কালপুরুষ’ উপন্যাসের অর্ক এবং মাধবীলতার কথা খুব মনে পড়ে। এর বাইরে আমরা যদি আমাদের বাংলাদেশের লেখকদের কথা বলি তাহলে সৈয়দ শামসুল হকের লেখায়, শওকত আলী, রশীদ করিম, সেলিনা হোসেন, রাবেয়া খাতুন, রিজিয়া হোসেনের লেখায় সেই রোমান্টিকতার জায়গা দেখি। বলা হয় আমার বেশিরভাগ উপন্যাস প্রেমের। আমার ‘নুরজাহান’ উপন্যাসের নুরজাহান চরিত্রের মধ্যে আমি আবেগকে দেখিয়েছি। পারুল নামে একটা নারী চরিত্র আছে, তার প্রেমের কথা আছে। তিনটি সন্তান নিয়েও সে আরেকটি প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। মোট কথা বাংলা সাহিত্যের অনেকটাই দখল করে আছে প্রেম।

চিরায়ত উপন্যাসের কালোত্তীর্ণ নারী চরিত্র

বাঙালী জীবনে সাহিত্যের প্রভাব কতটুকু তার পরিমাপ করাটা বেশ কঠিন বলা যায়। কারণ বাংলা সাহিত্য বিশেষত উপন্যাসের চরিত্রগুলোর প্রভাব আমরা দেখি আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে, আমাদের নাটক, চলচ্চিত্র এমনকি সংগীতেও। শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এবং আরো অনেক সাহিত্যিকদের সৃষ্ট অমর চরিত্রগুলোর পোশাক, সাজ, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রভাব আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মিশে আছে। বাঙালি নারীর সাজ পোশাক বা ফ্যাশনে মিশে আছে শেষের কবিতার লাবণ্য, কেতকী, রক্তকরবীর নন্দিনী, দেবদাসের পার্বতী, কালবেলার মাধবীলতা, সাতকাহনের দীপা, হুমায়ুন আহমেদের হিমু চরিত্রের নায়িকা রূপা সহ আরো অনেক অমর চরিত্র। আমরা এখানে চেষ্টা করেছি অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে প্রায় দেড়শ বছরের বাংলা উপন্যাসের কয়েকজন প্রখ্যাত সাহিত্যিকদের অমর উপন্যাসগুলোর প্রেমিকা নারী কিংবা নায়িকা চরিত্রগুলোকে স্বল্প পরিসরে তুলে ধরতে।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃণালিনী: সাহিত্যিক বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়ের তৃতীয় উপন্যাস। মূলত ঐতিহাসিক উপন্যাস, তুর্কী সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজীর বাংলা আক্রমণের পটভূমিতে উপন্যাসটি রচিত। রাজপুত্র হেমচন্দ্র এবং মৃণালিনীর প্রেমকাহিনীকে কেন্দ্র করে এর গল্প। দেশ রক্ষার জন্য হেমচন্দ্র বিভিন্ন কারণে মৃণালিনীর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করতে বাধ্য হয় এবং ষড়যন্ত্রের শিকার হয়। মগধের স্বাধীনতা রক্ষার্থে শিক্ষক মাধবাচার্যর প্রতারণায় সে মৃণালিনীকে হারায়৷ শিক্ষক মাধবাচার্য মৃণালিনীকে বন্দি করে রাখেন। যদিও শেষ পর্যন্ত তারা সফল হন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতার লাবন্য: “হে মোর বন্যা, তুমি অনন্যা,/ আপন স্বরূপে আপনি ধন্যা।”
লাবণ্য সম্পর্কে অমিতের এই উক্তি থেকেই ‘শেষের কবিতা’র নায়িকা লাবণ্যের পরিচয় পাওয়া যায়। আর পাঁচটি মেয়ের চেয়ে সে আলাদা। লাবন্যর নিজস্ব একটা জগৎ আছে। সেখানেই সে অনন্য। অমিতের সাথে যখন প্রথম দেখা হয় লাবণ্য’র পরনে ছিল সরু পাড় দেয়া সাদা আলোয়ানের শাড়ি, তার উপরে আলোয়ানের একটি জ্যাকেট। জ্যাকেটের হাত কবজি পর্যন্ত। দু হাতে দুটি সরু প্লেন বালা। পায়ে সাদা চামড়ার দেশি ছাঁদের জুতো। চুল আঁট করে বাঁধা। অর্থাৎ লাবণ্য সাজ পোশাকেও অনন্য। অমিত তাই প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো। লাবণ্যর জীবন আলোড়িত করে অমিত আসে। তাদের বিয়েও ঠিক হয়। কিন্তু অমিতের জীবনে কেতকির অবস্থানের কথা জানার পর লাবণ্য সম্পর্ক থেকে সরে আসে। এখানে লাবণ্যকে আমরা কিছুটা রক্ষণশীল বা ব্যাকডেটেড-ও বলতে পারি কিন্তু তার আত্মপ্রত্যয় ও আদর্শকে অস্বীকার করার উপায় পাঠকের নেই।

“হে মোর বন্যা, তুমি অনন্যা,/ আপন স্বরূপে আপনি ধন্যা।”

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পার্বতী : ভালোবাসার অমর উপাখ্যান ‘দেবদাস’। দেবদাসের নায়িকা পার্বতী বিশ শতকেই বাঙালি হৃদয়কে নাড়া দিয়েছিলো। উপন্যাসে পার্বতীর অভিমানগুলো পত্রপল্লবের মতো ছড়িয়ে পড়লেও তার চরিত্রের দৃঢ়তা, ঋজুতা, সাহসিকতা প্রত্যাখ্যানের মতো মানসিকতা তাকে অনন্য করে। তাই সে যখন গভীর রাতে একাকী দেবদাসের ঘরে ঢোকে, তখন সমকালীন নারীর অবস্থান থেকে তাকে ভিন্নতর মনে হয়। তাকে দেখে দেবদাস ভীত, সঙ্কুচিত হয়। যে কারণে সে ভীতচকিতের মতো বলে, “কিন্তু আমিই কি মুখ দেখাতে পারব’। জবাবে পার্বতী তেমনি অবিচলিত কণ্ঠে উত্তর দিল, ‘তুমি? কিন্তু তোমার কি দেবদা? একটুখানি মৌন থাকিয়া পুনরায় কহিল, তুমি পুরুষ মানুষ। আজ না হয় কাল তোমার কলঙ্কের কথা সবাই ভুলবে? দু’দিন পরে কেউ মনে রাখবে না। কবে কোন্ রাতে হতভাগিনী পার্বতী তোমার পায়ের ওপর মাথা রাখার জন্য সমস্ত তুচ্ছ করে এসেছিল।” পার্বতী দেবদাসের পায়ের ওপর মাথা রেখে বলেছিলো, ‘এইখানে একটু স্থান দাও, দেবদা।’ কিন্তু দেবদাস চরিত্র এত দৃঢ় ছিল না। দেবদাস পারুকে এক চিঠিতে লেখে, “তোমাকে আমি যে বড় ভালবাসিতাম, তাহা আমার কোনদিন মনে হয় নাই। আজও তোমার জন্য আমার অন্তরের মধ্যে নিরতিশয় ক্লেশ বোধ করিতেছে না। শুধু আমার বড় দুঃখ যে, তুমি আমার জন্য কষ্ট পাইবে। চেষ্টা করিয়া আমাকে ভুলিও এবং আন্তরিক আশীর্বাদ করি, তুমি সফল হও।” দেবদাসের এ কথায় বয়সী দ্বিজবর এবং সন্তানের পিতার সঙ্গে বিয়ে ও সংসার যাপনে পার্বতী বিন্দুমাত্র হতাশা, দুঃখ, ক্লেশের প্রকাশ ঘটায়নি। বরং এটাই যেন বাস্তবতা এবং তাকে মেনে নিয়ে এগিয়ে যে তাকে যেতে হবে, সেই বোধ তাড়িত হয়ে সে সংসারের কাজকর্মে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পেরেছিল। এক প্রত্যাখাত নারী তার আত্মসম্মানটুকুর মূল্য দিতেই যেনো সরে গিয়েছিলো।

“তোমাকে আমি যে বড় ভালবাসিতাম, তাহা আমার কোনদিন মনে হয় নাই। আজও তোমার জন্য আমার অন্তরের মধ্যে নিরতিশয় ক্লেশ বোধ করিতেছে না। শুধু আমার বড় দুঃখ যে, তুমি আমার জন্য কষ্ট পাইবে। চেষ্টা করিয়া আমাকে ভুলিও এবং আন্তরিক আশীর্বাদ করি, তুমি সফল হও।”

মৈত্রীয়ী দেবীর ন হন্যতে: কথাসাহিত্যিক মৈত্রীয়ী দেবী রচিত আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। ১৯৩০ সালে কলকাতায় মৈত্রেয়ী দেবীর বাবা, প্রফেসর সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তর কাছে পড়তে আসেন রোমানিয় ছাত্র মিরচা এলিয়েড। মৈত্রেয়ী দেবীর বয়স তখন ১৬ বছর। তাদের মধ্যে একটা ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয় যা প্রকাশ পাবার পর মিরচা এলিয়েডকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেন মৈত্রীয়ীর বাবা। পরে দুজনেই তাদের অপূর্ণ প্রেম, ভালোবাসা নিয়ে নিজের বর্ণনায় দুটি বই লেখেন। ১৯৩০ সালের ঘটনার স্মৃতিচারণ মৈত্রীয়ী করেছিলেন চল্লিশ বছর পর।

কাজী নজরুল ইসলামের ‘বাঁধনহারা’র মাহবুবা: একটি পত্রোপন্যাস কী করে প্রেমের বাঁধন ছেড়ার গল্প বলে তা দেখিয়েছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। নুরুল হুদা ও মাহবুবার প্রেম পরিণয় পর্যন্ত গড়ায় না। নুরুল হুদা যোগ দেয় সেনাবাহিনীতে আর মাহবুবার বিয়ে হয়ে যায়। এক পর্যায়ে বিধবা মাহবুবা সমস্ত বাঁধন ছিড়ে নুরুল হুদার কর্মস্থল বাগদাদের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়।

আশাপূর্ণা দেবীর সত্যবতী: বাংলায নারীবাদী সাহিত্যের কথা বললে প্রথমেই আসে আশাপূর্ণা দেবীর ত্রয়ী উপন্যাস, প্রথম প্রতিশ্রুতি (১৯৬৪), সুবর্ণলতা (১৯৬৭), এবং বকুলকথা (১৯৭৪)। প্রথম উপন্যাসের নারী সত্যবতী বুদ্ধি, যুক্তিবাদ, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর। তার ভালোবাসা আবর্তিত হয় স্বামী নবকুমার, দুই ছেলে ও এক মেয়ে সুবর্ণলতাকে ঘিরে। এই মায়াবী নারীই প্রতিবাদী হয়ে সংসার ত্যাগ করেন যখন তিনি জানতে পারেন তাকে না জানিয়েই তার আট বছরের মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে।

সমরেশ মজুমদারের ‘গর্ভধারিনী’র জয়িতা: জয়িতা বিপ্লবী ও বুদ্ধিমতি নারী, তার অস্তিত্বে মিশে আছে সমাজ বদলানোর নেশা। এর প্রমাণ পাওয়া যায়, যখন সে পাহাড়িদের মাঝে মিশে গিয়ে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী পুরুষটিকে ভালোবাসে। সে পুরুষের সন্তান নিজ গর্ভে ধারণ করে। গ্রামের পাহাড়ি মানুষগুলো তার কাছে ভণিতাহীন, অকৃত্রিম ও স্বচ্ছ। ধনী পরিবারের শহুরে ও শিক্ষিত মেয়ে হয়েও জয়িতা প্রান্তিক মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের তাগিদে হয়ে ওঠে তাদেরই একজন। শহরের তথাকথিত আধুনিক মানুষগুলোর ভেতর সে দেখে - "পুরু চামড়ার নখদন্তহীণ চোখের পর্দা-ছেঁড়া আত্নসম্মানহীন কয়েক লক্ষ বাঙালী, গর্তে মুখ লুকিয়ে এ ওকে গালাগাল দিয়ে যাচ্ছে।"

সেলিনা হোসেনের ‘মোহিনীর বিয়ে’র মোহিনী: সেলিনা হোসেন মোহিনীর বিয়ে উপন্যাসে একটি মেয়ের করুণ আখ্যান রচনা করেছেন। পতিতাপল্লী থেকে উঠে আসা তরুণীর পুরো নাম মোহিনী মহুয়া মঞ্জুর। মহুয়ার প্রিয় কবিতার চরণ, “গণিকা আমার অপ্সরা প্রিয়তমা/ শাড়ি খুলে রেখে পরো আকাশের নীল/ যুগল কুসুম থরথরো অনুপমা/ চোখ দুটি হোক জ্যোৎস্নায় গাঙ্চিল।” মোহিনীর জীবন বড় অদ্ভুত। তার বাবা রমজান আলী প্রেমিকা নাসিমাকে পতিতালয় বিক্রি করে দেয়। নাসিমার ঘরে জন্ম নেয়া ছেলে সন্তানকে ঘরে তোলে নিজের ছেলে হিসেবে। আর রমজানের বৈধ সন্তান মোহিনীকে দিয়ে যায় নাসিমার কাছে পতিতাপল্লীতে। মোহিনীর জীবনের চূড়ান্ত ট্র্যাজেডি তৈরি হয় যখন তার বিয়ে ঠিক হয়। ভদ্রপল্লীতে মোহিনীর জায়গা হয় না, তার বিয়ের স্বাদ অপূর্ণই থাকে।

“গণিকা আমার অপ্সরা প্রিয়তমা/ শাড়ি খুলে রেখে পরো আকাশের নীল/ যুগল কুসুম থরথরো অনুপমা/ চোখ দুটি হোক জ্যোৎস্নায় গাঙ্চিল।”

হুমায়ুন আহমেদের ‘কোথাও কেউ নেই’ এর মুনা: খুব জনপ্রিয় উপন্যাস ‘কোথাও কেউ নেই’ এবং এর নাট্যরূপ এখনো সমানভাবে জনপ্রিয়। তেমনি জনপ্রিয় এ উপন্যাসের দুই চরিত্র মুনা ও বাকের ভাই। মামার বাড়িতে মানুষ আপাতদৃষ্টিতে শক্ত চরিত্রের মুনার চারিত্রিক দৃঢ়তা, আত্মপ্রত্যয় পাঠকের মনে ছাপ ফেলে। মুনার আত্মমর্যাদাবোধ অভিভূত করে। শৈশবে সে যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছিলো। প্রেমিকের কাছেও এহেন আচরণ পেয়ে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত মুনা একা লড়ে চলে শেষ অব্দি। এই সংবেদনশীল বিষয়গুলো গল্পের ভাঁজে ভাঁজে মমতা নিয়ে লিখেছেন লেখক। শেষ পর্যন্ত মুনা হয়ে যায় একা। তার কোথাও কেউ থাকে না।

XS
SM
MD
LG