রোজকার রুটিনবাধা জীবন থেকে একটু মুক্তি, একটু নিঃশ্বাস নেয়ার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ার কোনো বিকল্প হয় না। সারা বছরের দৌড়ঝাঁপ, অফিস মিটিং, ডেডলাইন, সংসার, পরিবার, সন্তানদের স্কুল-পরীক্ষা সব মিলিয়ে শরীর-মন যখন ক্লান্ত, তখন ঘুরে আসুন প্রকৃতির কাছাকাছি কোথাও।
সাধারণত ঘুরবার জন্য সবাই শীতকালটাকেই বেশি বেছে নেয়। এর কিছু কারণও আছে। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি এ সময়টাতেই বাংলাদেশে শীতকালীন তাপমাত্রা থাকে। আবহাওয়ায় বেশ একটা শীত শীত আমেজের সঙ্গে ছুটিছাটাও যোগ হয়। এসময়টা স্কুলগুলোতে বাৎসরিক ছুটি থাকে, চাকুরিজীবিরাও বাৎসরিক জমা ছুটি নিয়ে তাই পরিবারের সাথে একটা বড় অবকাশযাপনের পরিকল্পনা করে ফেলতে পারেন।
কোথায় যাবেন
প্রায় আট বছর ধরে ভ্রমণসেবা দিচ্ছে রাজধানী ট্যুরিজম। এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী জাবের আহমেদ পলাশ ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “এসময়টায় সবচেয়ে বেশি ট্যুর হয় সুন্দরবনে। শীতকালই এ ট্যুরের জন্য উপযুক্ত সময়। এছাড়া এ সিজনে পর্যটকরা কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিনেও ঘুরতে যান। সাধারণত নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়টাতে কক্সবাজারে টুরিস্টের আনাগোনা বেশি থাকে। সুন্দরবন ভ্রমণ সেপ্টেম্বর থেকেই শুরু হয়ে যায়। তবে নভেম্বর মাস থেকে ট্যুর বেশি হয়। বড় জাহাজগুলোর চলাচল শুরু হয়। এখানে এ সিজনে প্রায় ৩০-৩৫টা জাহাজ চলে। জানুয়ারি পর্যন্ত বেশিরভাগ ট্যুর বুক হয়ে যায়। সুন্দরবনে চারটা স্পটে মূলত টুরিস্টদের নিয়ে জাহাজগুলো যায়। সেগুলো হলো, কটকা, কচিখালী, হারবাড়িয়া, করমজল। কচিখালী ও কটকা অভয়ারণ্য। এখানকার স্পট সবচেয়ে সুন্দর। কটকায় জঙ্গল ট্র্যাকিং হয়, ঝাঁকে ঝাঁকে হরিণ দেখা যায়, দু’তিন জায়গায় সি-বিচ পাওয়া যায়। কটকা, ডিমের চর, কচিখালী এগুলোতে সি-বিচ রয়েছে। কিছুকিছু জাহাজ হিরণপয়েন্ট ও দুবলার চর পযন্ত যায়।”
পলাশ বললেন, “পাশাপাশি শীতকালে বেড়ানোর অন্যতম জায়গা হলো সেন্টমার্টিন। এখানে অসংখ্য পর্যটক যায়। তবে সেন্টমার্টিনের পরিবেশগত দিক বিবেচনায় সেখানে এখন সরকার পর্যটক নিয়ন্ত্রণ করছেন। কক্সবাজারে এই সিজনে তিনদিনের ছুটি মানেই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বিচে তিল ধারণের জায়গা থাকে না। হোটেলগুলো খালি থাকে না। পার্বত্য অঞ্চলগুলোর মধ্যে সাজেক, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবনের কিছু অংশে ট্যুর চলছে, তবে এ সব জায়গায় মেঘ দেখতে যেতে চাইলে বর্ষাকালে ভ্রমণ করতে হবে। সিলেটের মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল এ সময়ে বেড়াবার জন্য ভালো। এসব জায়গায় দর্শনীয় স্থানের মধ্যে আছে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবপুর লেক, ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত।” পলাশ জানালেন, রাজধানী ট্যুরিজম থেকে এ সময়ে তাঁরা সুন্দরবন ট্যুরের অফার দিচ্ছেন। এছাড়াও বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি-সাজেক ভ্রমণের আয়োজনও করছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নৈসর্গিক সৌন্দর্যের এক অন্যতম লীলাভূমি। রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নে রয়েছে সাজেক ভ্যালি। ভারতের মিজোরাম সীমান্তের গা ঘেঁসে এর অবস্থান। বান্দরবান ভ্রমণে বেড়িয়ে আসতে পারেন সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ২২০০ ফুট উচ্চতায় মেঘের রাজ্য নীলগিরি থেকে। এছাড়াও বান্দারবানে দেখতে পারেন শৈলপ্রপাত ঝর্ণা, মিলনছড়ি ভিউ পয়েন্ট, চিম্বুক পর্যটন কেন্দ্র, স্বর্ণমন্দির, সাইরু হিল রিসোর্ট। কক্সবাজার ভ্রমণের পরিকল্পনা থাকলে একবারে কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে ঘুরে আসুন রামু-কক্সবাজার-টেকনাফ-সেন্টমার্টিন। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত ছাড়াও এখানে জনপ্রিয় স্থানগুলোর মধ্যে আছে রামু বৌদ্ধ বিহার, সীমা বিহার, রাংকূট বৌদ্ধ বিহার, রামু রাবার বাগান, ইনানী বিচ, হিমছড়ি, মেরিন ড্রাইভ, মহেশখালী, সোনাখালী, কুতুবদিয়া দ্বীপ। বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের উপজেলা টেকনাফে দেখতে পারেন নাফ নদী, টেকনাফ সমুদ্র সৈকত, মাথিনের কূপ ইত্যাদি।
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের কুয়াকাটাকে বলা হয় সাগরকন্যা। কুয়াকাটা দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র সমুদ্রসৈকত যেখানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়। দীর্ঘ সমুদ্রসৈকতের পাশাপাশি এখানে দেখার আছে গঙ্গামতির জঙ্গল, কাঁকড়ার দ্বীপ, ফাতরার বন, সীমা বৌদ্ধমন্দির, রাখাইন পল্লী ইত্যাদি।
বাংলাদেশে পর্যটন
দেশের ভেতরে ও বাইরে ভ্রমণের ক্ষেত্রে এখন অনেক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে । এখন অনেক ট্রাভেল এজেন্সি আছে, সোশ্যাল মিডিয়াতে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ট্যুরিজম গ্রুপ। তাই একা কিংবা পরিবার নিয়ে বেড়াতে চাইলে এই সব প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন সহজেই। ভ্রমণের মৌসুমে বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সি, এয়ারলাইন্স, পর্যটন এলাকাগুলোর হোটেল, রিসোর্টগুলোতে থাকে নানান ডিস্কাউন্ট। সারা বাংলাদেশে ‘বাংলাদেশে পর্যটন কর্পোরেশনে’র ২৩টি মোটেল রয়েছে। এগুলোর নাম, ফোন নম্বর, কক্ষ ভাড়া সহ সকল তথ্য পেয়ে যাবেন বাংলাদেশে পর্যটন কর্পোরেশনের ওয়েবসাইটে।
বাংলাদেশের ভ্রমণ বিষয়ক একটি বড় সামাজিক প্লাটফর্ম ট্রাভেলারস অফ বাংলাদেশ(টিওবি)। গ্রুপের সংগঠক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ জানালেন গ্রুপটি তারা শুরু করেন ২০০৮-২০০৯ সালের দিকে। বললেন, “তখন এটি একেবারেই ফেসবুকভিত্তিক গ্রুপ ছিলো। সে সময়ে একটা সমস্যা ছিলো, আমরা যারা ঘুরতে যেতে চাইতাম, ঘুরতে যাওয়ার জন্য মনের মতো লোক খুঁজে পেতাম না। যারা একটু কম খরচে ঘুরতে যেতে চায়, আবার নিজেদের মতো থাকতে চায় এমন পছন্দসই লোক খুঁজে বেড়িয়ে পড়ার জন্যই আমরা গ্রুপটি খুলি। একটা হেল্পিং গ্রুপ হিসেবেই প্রথমে গ্রুপটি খুলি। আমাদের সাথে মানসিকতা মেলে এমন লোকজনকে নিয়ে আমরা ঘুরতে যেতাম। কোনো একটা ডেস্টিনেশন ঠিক করে আমরা গ্রুপ মেম্বাররাই প্ল্যানিং থেকে শুরু করে লজিস্টিক সব কাজের সাথে যুক্ত থাকতাম। খরচটাও আমরা সমানভাবে ভাগ করে নিতাম। পরবর্তীতে আমরা ভ্রমণ সংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হই। এখন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে এক মিলিয়নের ওপরে সদস্য রয়েছে। টিওবির বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্যে আছে ব্যাকপ্যাকিং, এডভেঞ্চার ট্রেকিং, বিচ হাইকিং, মাউন্টেনিয়ারিং, কমিউনিটি ট্যুরিজম বা ইকো ট্যুরিজম, পযটন কেন্দ্রসমূহে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো, পর্যটন তথ্য সহায়তা প্রদান। এছাড়া বিভিন্ন আউটডোর একটিভিটি সরাসরি নিজেরা না করলেও সামগ্রিক সহায়তা করি। ২০২০ সাল থেকে কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভে আমরা একটি আল্ট্রা-ম্যারাথন প্রোগ্রাম করছি যার নাম মেরিন ড্রাইভ আল্ট্রা। এটা একটি লম্বা ম্যারাথন। যেখানে ৫০ কিলোমিটার, ১০০ কিলোমিটার এবং ১০০ মাইলেরও দৌড় হয়।”
সম্প্রতি (০১ডিসেম্বর-০৩ডিসেম্বর) ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয় পর্যটন মেলা ‘বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেলস এন্ড ট্যুরিজম এক্সপো’। মেলা ঘুরে প্রচুর ভ্রমণপিপাসু মানুষের সমাগম দেখা যায় । কেউ কেউ হোটেল বুকিং দিচ্ছেন, বিশেষ ছাড়ে বিমানের টিকেট ক্রয় করছেন। মেলাতে ৮০টি স্টলে বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, মালদ্বীপসহ ১৫টি দেশের প্রতিষ্ঠান মেলায় অংশ নেয়। মেলায় বিভিন্ন ভ্রমণসেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান, হোটেল, এয়ারলাইন্স সবাই ভ্রমণে বিশেষ মূল্য ছাড় দেন। হোটেল ও রিসোর্টগুলো ১০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়, শূন্য ইন্টারেস্টে কিস্তিতে এয়ারটিকেট ক্রয়, এরকম আরো নানান অফার দেখা যায়।
বেড়াতে যাবার ক্ষেত্রে করণীয়:
এই শীতে যারা বেরিয়ে পড়ার পরিকল্পনা করছেন, তাদের ভ্রমণকে সহজ করবার জন্য প্রয়োজন কিছু প্রস্তুতির এবং কিছু সচেতনতার, যা আপনার ভ্রমণের আনন্দকে বাধাহীন করতে সাহায্য করবে।
· যেখানে যাচ্ছেন সে এলাকার আবহাওয়া সম্পর্কে জানুন। গুগলে ওয়েদার ফোরকাস্ট দেখে সে অঞ্চলের তাপমাত্রা জেনে নিন, এর ফলে আপনি প্রয়োজনীয় কাপড়, আনুষাঙ্গিক জিনিস নিতে পারবেন। যদি পাহাড়ি এলাকায় যান, যেখানে শীতের তীব্রতা বেশি ; তাহলে পরিবারের শিশুদের জন্য বেশি করে গরম জামা-কাপড় সঙ্গে নিন।
· গুগল ম্যাপ দেখে যে জায়গায় যাচ্ছেন সে জায়গা ও তার আশেপাশের এলাকাগুলো সম্পর্কে ধারণা নিন।
· প্রয়োজনীয় ওষুধ, সানগ্লাস, স্লিপার, স্পোর্টস শু ট্রাভেল ব্যাগে আগেই ঢুকিয়ে রাখুন। যেখানে যাচ্ছেন, সেখানে পাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকলে পরিবারের ছোটদের জন্য পানি, খাবার, ওষুধ ইত্যাদি সঙ্গে নিয়ে নিন।
· রাজধানী ট্যুরিজমের প্রধান নির্বাহী জাবের আহমেদ পলাশ পরামর্শ দিলেন, যারা পরিবার নিয়ে নিরিবিলি অবসর কাটাতে চান, ভ্রমণের পরিকল্পনা করার ক্ষেত্রে সাপ্তাহিক ছুটি ও সরকারী ছুটি মিলিয়ে যে তিন-চারদিনের ছুটিগুলো পাওয়া যায় সেগুলোকে এড়িয়ে চলতে। কারণ এ দিনগুলোতে ট্যুরিস্ট এরিয়াগুলোয় তিল ধারণের জায়গা থাকে না। হোটেল, রেস্তোরা, ট্যুরিস্ট স্পট সবজায়গায় অতিরিক্ত ভীড় থাকে।
· ভ্রমণের ক্ষেত্রে নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রাখা খুবই জরুরী। যে এলাকায় যাচ্ছেন, সেখানে একা ঘুরে বেড়ানো নিরাপদ কিনা, ট্যুরিস্ট স্পটটি অপরাধপ্রবণ এলাকায় কিনা, এখানে সন্ধ্যার পর চলাচল করা যায় কিনা ইত্যাদি জেনে নিন। সেই এলাকার ট্যুরিস্ট পুলিশের নম্বর সাথে রাখুন। জরুরী প্রয়োজনে বাংলাদেশে ট্যুরিস্ট পুলিশের হটলাইন নম্বরে যোগাযোগ করুন। এছাড়াও ট্যুরিস্ট পুলিশের সেবা নিতে “Hello Tourist” অ্যাপটি আপনার মুঠোফোনে ইন্সটল করে রাখতে পারেন।
· এটিএম কার্ড, ন্যাশনাল আইডি কার্ড, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে পাসপোর্ট ইত্যাদি প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট সঙ্গে রাখুন।
· সমুদ্র সৈকতে গেলে দলছুট হয়ে একা স্নান করতে যাওয়া, রাতের অন্ধকারে সমুদ্রের পানিতে নামা থেকে বিরত থাকুন। পাহাড়ে গেলেও একা একা রাত বিরেতে বেড়িয়ে পড়া, ট্র্যাকিংয়ের উপযুক্ত জুতা ছাড়া পাহাড়ে চড়া থেকে বিরত থাকুন।
· যেখানে সেখানে চকলেট, চিপস, জুস, বিস্কিটের প্যাকেট, পানির বোতল ইত্যাদি ফেলে পরিবেশ নষ্ট করা থেকে বিরত থাকুন।