মন্দার ভেতর বাংলাদেশের কয়েকটি ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে নামে-বেনামে নেওয়া হাজার-হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন দেশটির অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করা কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেছেন, বিশাল অঙ্কের ঋণের খবর সামনে আসার পর এবং আগের কিছু ‘স্টোরি’ দেখে বোঝা যাচ্ছে এই টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতির জন্য তারা ‘সরকারের নিষ্ক্রিয়তা’ এবং ব্যাংকিং নীতিমালায় পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্তকে দুষছেন।
ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ‘‘যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা কয়েক দিন আগে সিঙ্গাপুরে পৌনে দুইশ মিলিয়ন ডলার দিয়ে হোটেল কিনে ফেলল। এই অর্থ কোথা থেকে পায়? টাকা তো তাহলে পাচার হয়ে গেছে। আগের স্টোরি আর এখনকার স্টোরির ভেতর কিন্তু মিল আছে। টাকা পাচার এবং ব্যাংকিং খাতের এই অবস্থার ভেতর একটা লিংক আছে। সরকারের নিষ্ক্রিয়তা এখানে বড় ফ্যাক্টর।’’
বাংলাদেশের ব্যাংকখাত নিয়ে অভিযোগ বহু পুরনো। কিন্তু বর্তমান সময়ে সেটি নতুন ‘নজির’ সৃষ্টি করেছে। বলা হচ্ছে, স্বাধীনতার পর ঋণের নামে এমন ব্যাংক কেলেঙ্কারির কথা আগে শোনা যায়নি। আগে অধিকাংশ সময় রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এ ধরনের অভিযোগ উঠত। কিন্তু এখন বেসরকারি ব্যাংকগুলো নিয়েও অহরহ অভিযোগ আসছে।
বাংলাদেশের দৈনিক প্রথম আলো গত ২৪ নভেম্বর ইসলামী ব্যাংকে ‘ভয়ংকর নভেম্বর’ শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, নাবিল গ্রুপের নামে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড থেকে দুই হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে একটি অসাধু চক্র। আর আটটি প্রতিষ্ঠানের নামে চলতি বছর সব মিলিয়ে বিভিন্ন উপায়ে ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে শুধু এস আলম গ্রুপ এককভাবে ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে বলেও ৩০ নভেম্বর ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়।
খবরগুলো সামনে আসার পর সরকারের পক্ষ থেকে কিংবা অভিযুক্ত গ্রুপের পক্ষ থেকে এখনো কোনো বিবৃতি দেওয়া হয়নি। অভিযোগগুলো কেউ অস্বীকারও করেননি। তবে মূল অভিযোগের প্রসঙ্গ এড়িয়ে ইসলামী ব্যাংক শুধু বলেছে, ব্যাংকখাতের সব সূচকে এখনো তারা শীর্ষে।
ঋণ অনিয়ম নিয়ে এসব খবরের প্রতিবেদন গত ৩০ নভেম্বর হাইকোর্টের নজরে আনা হলে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের বেঞ্চ রিট আবেদনের পরামর্শ দেন।
ব্যাংকখাতের বর্তমান নীতিমালাকে ‘ভুল’ উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, ‘‘ব্যাংকিংখাতে সমস্যা বেশ আগে থেকে। ভুল পলিসির কারণে এসব হচ্ছে। দুইতিন বছর আগে পলিসি রিফর্ম হয়েছে। এটার খুব নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। পরিচালনা পর্ষদে যেখানে এক পরিবারের দুইজন সদস্য থাকার কথা, সেখানে পাঁচজন করেছে। তিন বছরের জায়গায় ছয় বছর বাড়িয়ে ৯ বছর করেছে। এগুলো একেবারে যুক্তিহীন কাজ। এজন্যই আজকে এ অবস্থা দাঁড়িয়েছে।’’
‘‘মনিটরিং বা সুপারভিশনের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিয়ত যা করার কথা ছিল, করেনি। শক্ত অবস্থান নেয়নি। ডিফল্ট ঋণের বিষয়ে বহু সময় দেওয়া হচ্ছে। বারবার সময় বাড়ানো হচ্ছে। ডাউন পেমেন্ট একেবারে কমিয়ে আনা হলেও ঋণ পরিশোধ হচ্ছে না।’’
‘‘ব্যাংকের মূল দায়িত্ব পরিচালনা পর্ষদের হাতে। তারা একযোগে কাজ করেনি, শৃঙ্খলা রক্ষা করেনি। পরিচালকদের অনেক রকম স্বার্থ আছে। তারা নানা ব্যবস্থাপনায় নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করেন। ব্যবস্থাপনায় আবার যারা উপরের লেভেলে আছেন, তারা একটা কমফোর্টজোনে থাকার চেষ্টা করেন। যাতে পরিচালক বা চেয়ারম্যান কিছু মনে না করেন। অনেক কিছু তারা অ্যাভয়েড করেন। আবার ব্যবসায়ীরা নানা রকম চাপ সৃষ্টি করে। তারপর রাজনৈতিক চাপ তো আছেই। কারো আবার কানেকশন থাকে। তারা ইনফ্লুয়েন্স করে।’’
এসব ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, "যারা দুর্নীতি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে সোজাসুজি অ্যাকশন নিতে হবে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক ছাড়াও গত এক দশকে বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বহু ঋণ কেলেঙ্কারি ঘটেছে, যেগুলো ব্যাংক কেলেঙ্কারির ভিন্ন একটা ধরনকে নির্দেশ করে।’’
‘‘এই মুহূর্তে বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে যে সমস্যা দেখছি, তাকে মোকাবিলা করার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার ভেতর ব্যাংক ব্যবস্থা একটি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ব্যবস্থা একটি, পুঁজি বাজার একটি…এমন আরও আছে। আমাদের দুর্ভাগ্য হলো সবগুলো প্রতিষ্ঠানই দুর্বল অবস্থার ভেতরে রয়েছে,’’ মন্তব্য করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, ‘‘এখন যেহেতু একটি অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা বিরাজমান, তাই ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর এর লম্বা কালোছায়া পড়েছে। এমনিতেই এর ভেতর অন্ধকার ছিল, সেই অন্ধকার এখন প্রলম্বিত হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেউ কেউ এটাকে বড় ধরনের বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি করেছেন। এসব বিষয়ের প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে ধরনের নজরদারি দরকার ছিল, সেটা তারা পারছেন না। আমার আশঙ্কা এগুলো রাজনৈতিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আর প্রশাসনিক নজরদারির ভেতরে নেই। তাই রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছ থেকে কোনো ধরনের সংকেত না আসলে, এই প্রশাসন ব্যবস্থাপনাগতভাবে সব ধরে রাখতে পারবে বলে আমি মনে করি না।’’
এদিকে ঋণ কেলেঙ্কারির এই ঘটনা অনেকটা প্রকাশ্যে হয়েছে বলে মনে করেন আহসান এইচ মনসুর। তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, ‘‘এটা যে হবে তা সবাই জানতেন। শঙ্কা থাকার পরেও এটা হতে দেওয়া হলো। ইসলামী ব্যাংক সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে ভালো। সেখানে জেনেশুনে যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে কিছু বলার থাকে না।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘ব্যাংকখাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে ইতিবাচক কোনো পদক্ষেপ এখনো আমরা দেখছি না। ইসলামী ব্যাংক থেকে যে টাকাগুলো এখনো এসআলম গ্রুপ তুলতে পারেনি, সেটা হয়তো বাংলাদেশ ব্যাংক বন্ধ করেছে। এর বাইরে কিছু দেখছি না। বোর্ডকে ভেঙে দেওয়া, ম্যানেজমেন্টকে দায়বদ্ধ করার কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। কিছু লোককে শাস্তি দেওয়ার মতো অ্যাকশন হচ্ছে না। ’’
‘‘দীর্ঘদিন ধরে এই পরিণতি দেখছি। এখান থেকে বের হওয়ার কোনো প্রচেষ্টা সরকার নিচ্ছে না। তাই বাড়ছে। পত্রপত্রিকায় ইসলামী ব্যাংকের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এসআলম গ্রুপ ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এই একটা পরিবার আটটি ব্যাংককে নিয়ন্ত্রণ করে। এরপর তারা যদি হাজার-হাজার কোটি টাকা সরিয়ে ফেলে, তাহলে তো ব্যাংকিং খাতের অবস্থা দুর্বল হবেই। ইসলামী ব্যাংক ছাড়াও ছোট ছোট আরও অনেক ব্যাংক আছে। দশটি ব্যাংক ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবিড় তদারকিতে রয়েছে। সেগুলো নিয়েও সবাই শঙ্কায়।’’
উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়ক গবেষক মাহা মির্জা মনে করেন শক্তিশালী কোনো চক্রের যোগসাজশ ছাড়া এমন ঋণ কেলেঙ্কারি অসম্ভব, "ব্যাংকগুলো থেকে যেভাবে হাজার-হাজার কোটি টাকার ঋণ নেওয়া হচ্ছে, সেটি কোনোভাবেই হতে পারে না। সরকারের পাওয়ারফুল লোকের যোগসাজশ ছাড়া কোনোভাবে এটা সম্ভব নয়। ভেতরে খুবই শক্তিশালী একটা চক্র কাজ করছে। টাকাটা দেশে থাকছে কি না, সেটাও একটা ব্যাপার। সম্ভবত টাকাগুলো পাচার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো এখন কেন এভাবে ঋণ নেওয়া হচ্ছে?’’
‘‘সরকার এখন একটু টলমল অবস্থায় রয়েছে। একটু অস্থির সময় পার করছে। সামনে নির্বাচন, থাকবে কি থাকবে না-এই শঙ্কা থেকে যে যেভাবে পারছে টাকা তুলে নিচ্ছে।’’