অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির চাপে পরিবারের পুষ্টি নিয়ে উদ্বিগ্ন নারীরা


“ঘর ভাড়া দিয়া, খাওয়া খরচ, পোলাপাইনের লেখাপড়ার খরচ দিয়া ঢাকা শহরে আর থাকা যাইবো না আপা। পোষাইতে না পারলে বাড়িত যামু গা। চাইল, আটা, ত্যাল, চিনি সবকিছুর দাম এতো বেশি, পোলাপাইনডিরে খাওয়ামু কী?” কথাগুলো বলছিলেন মরিয়ম বেগম। মরিয়ম বেগম বাসাবাড়িতে ‘কাজের সহকারি’ হিসেবে কাজ করেন। কোনো বাসায় রান্না, কোনো বাসায় কাপড় ধোয়া, থালা-বাসন ধোয়া ইত্যাদি কাজ করে থাকেন। এতে মাসে প্রায় দশ হাজার টাকার মতো আয় হয়। মরিয়মের স্বামী গাড়ী চালক। ঢাকা শহরের আদাবর এলাকায় পাঁচ হাজার টাকায় এক রুম ভাড়া নিয়ে থাকেন তারা। তাদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। তবে মেয়েকে তিনি বাড়িতে মা’র কাছে রেখে এসেছেন। সেখানে সে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে । আর দুই ছেলে তার সাথেই থাকে, একজন সপ্তম শ্রেণীতে আর একজন নবম শ্রেণীতে পড়ে। বাজারে সব জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় ভীষণ বিপাকে পড়েছেন মরিয়ম। একদিকে সন্তানদের পড়ার খরচ, আরেকদিকে খাওয়ার খরচ সবকিছু নিয়ে দিশেহারা তিনি। মরিয়ম বলেন, "ট্রাকের থেইকা লাইনে দাঁড়াইয়া সদাই কিনলে দাম কম পড়ে। কিন্তু ট্রাকে দেয় শুধু দুই লিটার তেল, দুই কেজি মশুর ডাল আর এক কেজি চিনি, মোট ৪৩০ টাকার জিনিস। আবার দুপুর দুইটার পরে আর সদাই দেয় না। কাম শেষ কইরা যাইতে যাইতে দেরি হইয়া যায়। লাইনে দাঁড়ানোর টাইম পাইনা।”

নিম্ন আয়ের পরিবারের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে পন্য বিক্রয় করে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। এর জন্য ফ্যামিলি কার্ড করতে হয়। একজন কার্ডধারী সর্বোচ্চ পাঁচশত টাকার পন্য কিনতে পারেন। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, চিনি স্বল্পমূল্যে বিক্রয় করা হয়ে থাকে। মরিয়ম জানালেন, তিনি স্থানীয় কাউন্সিলারের অফিস থেকে ফ্যামিলি কার্ড সংগ্রহ করেছেন।

গত কয়েক মাস ধরে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্থির বাজার, দামের উর্ধ্বগতি ভোগাচ্ছে সাধারণ মানুষকে। মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষের চাল, ডাল, আটা, তেলের মতো দৈনন্দিনের খাদ্য উপকরণ কিনতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির “বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তা ও বিপন্নতা পর্যবেক্ষণ” শীর্ষক প্রতিবেদনে (১৩ অক্টোবর ২০২২ প্রকাশিত) জানা যায়, ‍বাংলাদেশের শতকরা ৮৮ ভাগ মানুষ খাদ্যের চড়া দামকে বিগত ছয় মাসে তাঁদের ওপর বড় আঘাত বলে মনে করছেন। খাবার কিনতে হিমশিম খাওয়া মানুষের হার ৬৮ শতাংশ। খাদ্যের এই দুর্মূল্য সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে নারীদের উপর। কারণ সংসার সামলানো ও পরিবারের খাদ্যব্যবস্থাপনার ভার সাধারণত নারীদের উপরেই থাকে। তাই জীবনযাত্রার খরচের এই বোঝা কীভাবে সামলাচ্ছেন তা ভয়েস অফ আমেরিকার পক্ষ থেকে জানতে চাই বিভিন্ন বয়স ও পেশার নারীর কাছে।

নাসরীন সুলতানা একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেন। তার স্বামী একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। দু'সন্তানের একজন নবম শ্রেণীতে আরএকজন চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। নাসরীন জানালেন, “এই মাস থেকে বাড়িওয়ালা বাড়িভাড়া বাড়িয়েছেন দুই হাজার টাকা। খাদ্যদ্রব্য, শিক্ষা উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় নাভিঃশ্বাস উঠার অবস্থা হয়েছে। খরচ সামাল দিতে দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় কিছু কাটছাট করতে হচ্ছে। সয়াবিন তেল যেখানে মাসে পাঁচ লিটার লাগতো এখন সেখানে তিন লিটার, সাড়ে তিন লিটারে চালানোর চেষ্টা করছি। বাসায় ভাজাভুজি খাবার বন্ধ করেছি। আমার শ্বশুরের জন্য রোজ দুইবেলা রুটি বানাতে হয়। আমরা নিজেরাও সকালে রুটি খাই। হাজব্যান্ড অফিসে লাঞ্চের জন্য রুটি নিয়ে যান। কিন্তু আটার দাম যেভাবে দিন দিন বাড়ছে রুটির বিকল্প কী হতে পারে সেটাই ভাবছি। এখন তো আর বাসায় কাউকে দাওয়াত দেয়া হয় না, খরচের ভয়ে। পরিবার নিয়ে বাইরে খাওয়া দাওয়াও করা হয় না তেমন একটা। সংসারের খরচ চালাতেই হিমশিম খাচ্ছি।”

পঞ্চাশোর্ধ শামীমা আফরোজ একজন গৃহিনী। ছেলে মেয়েরা বিয়ে-শাদী করে যার যার মতো থাকে। স্বামীর পেনশনের টাকায় সংসারে স্বামী-স্ত্রী দুজনের খরচ চলে যায়। কিন্তু আজকাল যেনো কোনোভাবেই কুলাতে পারছেন না তিনি। রোজকার অভ্যেস যে সকাল-বিকেল দু’বেলা দুধ-চা খাওয়া, সেটা এখন একবেলায় নিয়ে এসেছেন। আর একবেলা চালাচ্ছেন শুধু লিকার দিয়ে। শামীমা বললেন, “শুধু যে খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়েছে তা তো নয়। অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রের দামও তো বেড়েছে। আমরা হাজব্যান্ড-ওয়াইফ ডায়েবেটিক পেশেন্ট। আমাদের দু’জনকেই দু’বেলা ইনসুলিন নিতে হয়। ইন্সুলিনের দাম বেড়ে গেছে প্রতি এ্যাম্পুলে ৫০-৬০ টাকা। তাই বেঁচে থাকতে হলে খাবার-দাবারের খরচ কমিয়ে হলেও ওষুধ তো কিনতেই হবে।”

রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেলো, এ সপ্তাহে সব ধরণের মুরগী কেজিতে ১৫-২০টাকা কমেছে। ডিমের দাম কমেছে ডজনে ১০ টাকা। শীতকালীন সবজীর দাম সামান্য কম তবে এখনো সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। প্যাকেটজাত চিনি, আটা মিলছে না বাজারে। খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে কেজি ১১৫-১২০ টাকা দরে। আটা-ময়দার দাম প্রতি সপ্তাহেই বাড়ছে। চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৫-৭ টাকা। দাম বেড়েছে পাম অয়েল, সয়াবিন তেলের। লিটারে বেড়ে গেছে ৫-১০টাকা। বড় দানার মশুর ডালের দাম বেড়েছে। বেড়েছে ওয়াশিং পাউডার ও কাপড় ধোয়ার সাবানের দাম। আদা, পেয়াজের দাম কিছুটা কমলেও রসুন, জিরেসহ রান্নার সকল মশলার দাম বেড়েছে। দাম বাড়তি সকল নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের।

ঢাকার একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষিকা কানিজ ফাতেমা বললেন, “সৌখিন জিনিসপত্র কেনা একদমই বাদ দিয়েছি। শীতকালে আগে নিজের ব্যবহারের জন্য দু’জোড়া জুতা কিনতাম। এবার এক জোড়া কিনেছি। মানে যে খরচগুলো একদম না করলেই নয় সেগুলোই করছি। বাজারে গেলে আগে তো অনেক কিছু দেখলেই কিনতাম। অনেক রকম সবজী, ফল, খাবার। কিন্তু এখন সেটা আর করি না। যেটা আগে ১ কেজি কিনতাম সেটা ২৫০ গ্রাম কিনি। খাবারের দৈনন্দিন চাহিদায় যেটা না হলেই নয় সেটাই শুধু কিনি। এছাড়া গরুর মাংস, খাসীর মাংস তো কেনাই হয় না। দেশী মুরগী বাদ দিয়ে ফার্মের মুরগী খাচ্ছি। দেশী মুরগী মাসে একবার কিনছি। আমার তিনটা বাচ্চা, তাদের পুষ্টির কথা তো ভাবতে হবে। ডিম, দুধ এগুলো দাম বাড়লেও কিনতেই হয়। ঘরে তেল দিয়ে ভাজা খাবার কমানো হয়েছে। কাজের সহকারীকে বারবার রিমাইন্ডার দেয়া হয় যে, তেলের দাম কিন্তু বেশি, তরকারিতে কম কম ব্যবহার করো। আরেকটা ব্যাপার ঘটছে, কম দূরত্বের জায়গায় এখন রিকশার বদলে হেঁটেই যাচ্ছি। রাস্তায় বের হলে আগে হয়তো একটু ফুচকা খেতাম, ঝালমুড়ি খেতাম। এখন এগুলো বন্ধ করেছি। এভাবে দেখেন, স্বল্প আয়ের মানুষ যারা তাদের ইনকাম কিন্তু কমেই যাচ্ছে।”

রাজধানীর শ্যামলী এলাকার একটি নার্সিং কলেজের ছাত্রী মাহবুবা আশরাফী। কলেজের খুব কাছেই কয়েকজন মেয়ে রুম ভাড়া করে থাকেন। বললেন, “বাইরে বা কলেজ ক্যান্টিনে খাবার খেয়ে পোষায় না। খাবারের দাম অনেক বেশি, পরিমাণ কম। নিজেরা রান্না করে খাই। ব্যাচেলর মানুষ, সহজলভ্য প্রোটিন হিসেবে ডিমটাই তো বেশি খাওয়া হয়। কিন্তু ডিমের দাম, সবজির দাম অনেক বেশি। কী খাবো? বাসা থেকে যা টাকা পাঠায় তাতে চলা মুশকিল হয়ে গেছে। খাওয়া খরচেই সব চলে যায়। ব্যক্তিগত আরো খরচ তো আছে। কিন্তু এর চেয়ে বেশি পাঠাতেও বলতে পারি না। পরিবারই বা আর কত দেবে!”

সরকারী চাকুরীজীবি লামিয়া নুসরাত থাকেন মোহাম্মদপুরে। বাজার করেন মোহাম্মদপুরের কৃষিমার্কেট থেকে। বললেন, “বেতনের অর্ধেক টাকা চলে যায় বাজার করতে আর বাকি টাকা বাড়ি ভাড়ায়। সঞ্চয় বলে তো কিছুই নাই। মাসের সাত তারিখের পরে হাত শূন্য হয়ে যায়। আগে নাজিরশাইল চাল খেতাম। এখন বাধ্য হয়ে একটু কম দামের মোটা চাল খাওয়া শুরু করেছি। আটার দাম বেড়ে যাওয়ায় সকালে রুটি বানানো বন্ধ করে নাশতায় ভাত দিচ্ছি বাসার সবাইকে। বাজারে চিনির আকাল, চা খাই এখন একবেলা। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে করণীয় কী, জানি না।”

শ্যামলীর একটি অ্যাম্ব্রয়ডারির কারখানায় কাজ করেন শাহীনা খাতুন। শাহীনার স্বামী আগে একটি চায়ের দোকান চালাতেন, করোনার সময়ে তা বন্ধ করে দিতে হয়। এখন নির্দিষ্ট কিছু করেন না। যখন যে কাজ পান, সেই কাজ করেন। দুই সন্তান, বৃদ্ধ শ্বাশুড়ি নিয়ে শাহীনার সংসারে দামের উর্ধ্বগতির সাথে সামাল দিতে তাই বেসামাল অবস্থা। শাহীনা বলেন, “মাছ-মাংস কেনার সামর্থ নাই, শীতের শাক-সবজির দাম এখনো অনেক বেশি। শাক-সবজী সেদ্ধ করে অল্প তেল দিয়ে কোনোরকম ঝোল ঝোল করে রান্ধি, যাতে এক তরকারি দিয়েই ভাত খাওয়া যায়। ডিম, মাছ বা মুরগী রানলে বাচ্চাদের জন্য তুলে রাখি, আমি কোনোরকম ভাত খেয়ে নেই। দুই ছেলের একজনের বয়স সাত, আরেকজনের বয়স পাঁচ। বড়টারে স্কুলে ভর্তি করা দরকার, কিন্তু খরচ এমনে বাড়তে থাকলে ভর্তি করবো কেমনে? আয়-ইনকাম তো বাড়ে না। শুধু খরচ বাড়ে, জিনিসপত্রের দাম বাড়ে।”

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির জরিপ অনুযায়ী, ৫২ শতাংশ পরিবার প্রতিদিনের খাদ্যে ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করছে। ৫৬ শতাংশ পরিবার নিয়মিত আমিষ সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করতে পারছে। মাত্র ১৭ শতাংশ পরিবার মাছ-মাংস, সামুদ্রিক খাবারসহ পুষ্টিকর উপাদান সমৃদ্ধ খাবার খেতে পারছে। জরিপে দেখা গেছে, নিম্ন আয়ের মানুষের পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের হার অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বিশেষ করে শিশু, গর্ভবতী ও প্রসূতি মা, অপুষ্টিতে ভোগা নারীদের দৈনন্দিন খাবারে পুষ্টি নিশ্চিত করা উচিত। নিয়মিতভাবে এ খাবারগুলো না পাওয়া আশঙ্কাজনক।

XS
SM
MD
LG