একজন ময়নার কথা:
গাইবান্ধা জেলার মধ্য আনালের তারি গ্রামের মেয়ে মোসাম্মৎ মোসলেমিন আক্তার ময়না (৩৮)। স্বামী ও একমাত্র কন্যা সন্তান নিয়ে তার পরিবার। ১৯৯৮ সালে ময়নার বিয়ে হয়ে যায়। সে সময় তিনি দশম শ্রেনীর শিক্ষার্থী। বিয়ের পর পড়াশোনা আর চালাতে পারেননি। সংসারে টানাটানি ও অভাব অনটন থেকে নিস্তার পেতে নিজেও কাজে লেগে পড়েন। শুরু হয় তার সংগ্রাম।
১৫ অক্টোবর আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস। দিবসটির প্রাক্কালে কথা বলেছিলাম গাইবান্ধা জেলার প্রত্যন্ত গ্রামে বাস করা লড়াকু ময়নার সঙ্গে। ভয়েস অফ আমেরিকাকে ময়না জানান, কিভাবে তিনি তার পরিবারে ও নিজের জীবনে স্বচ্ছন্দ ফিরিয়ে এনেছেন। ময়নার গল্পটা এমন-
“বিয়ের পর প্রথমদিকে বিড়ির ফ্যাক্টরিতে বিড়ির পাতা বাঁধার কাজ করতাম। এক হাজার পাতা বাঁধলে দেড় টাকা পাওয়া যেতো। ২০০৫ সালে গ্রামীন ব্যাংক ও আশা (ASA) থেকে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে বাড়িতে বসেই কাজ শুরু করি। প্রথমে এদের থেকে তিন হাজার টাকা করে লোন নিছি। সেলাই মেশিন কিনে টুকটাক সেলাই ও হাতের কাজ করতে শুরু করি। পাশাপাশি স্বামীকে পুরনো গাড়ি (টেম্পো/অটোরিকশা) কিনে দিই। স্বামী সেই গাড়ি কিছুদিন চালাতেন। তারপর মেরামত করে আবার একটু বেশি দামে বিক্রি করে দিতেন। গাড়ি চালানোর রোজগারের টাকায় লোনের কিস্তি চলতো। এভাবে পাঁচবার গাড়ি কেনাবেচা করছি। আস্তে আস্তে লোনের পরিমাণ বাড়াই। তিন হাজার থেকে দশ হাজার, দশ থেকে বিশ হাজার। প্রথম প্রথম লোনের টাকা শোধ করতে কষ্ট হইতো। অনেক পরিশ্রম করা লাগতো।”
আস্তে আস্তে সেলাই মেশিন একটা থেকে তিন-চারটা হয়। আটোরিকশা থেকেও ইনকাম বাড়তে থাকে। ২০১৮ সালে নিজেদের থাকার জন্য নতুন বাড়ি করেন ময়না। ২০১৯ সালে তিনি বাড়ির কাছে হওয়া বাজারে জায়গা কিনে চারটি সেমি পাকা দোকানঘর তুলে ভাড়া দিয়েছেন। দোকান ভাড়া দিয়ে পাওয়া জামানতের টাকায় একটি জমি বন্ধক (লীজ) নিয়েছেন। সেই জমিতে চাষাবাদের কাজ হয় যা ময়না নিজেই তদারকি করে থাকেন। জমি নিড়ানো, বীজ বপন ইত্যাদি কাজ নিজের হাতে করেন। এখন তিনি আমন ধানের চাষ করছেন। আমন ধান তোলার পর ইরি ধানের চাষ করবেন। ময়না বললেন, “আমার স্বামী এখন গাইবান্ধায় একটা ময়দার মিলের গাড়ি চালকের কাজ করেন। এখন জীবনে কিছুটা আর্থিক স্বচ্ছলতা এসেছে। এখন আর বাইরের টুকটাক কাজগুলো আমাকে করতে হয় না।”
এই অর্থিক অভাব অনটন ও সংগ্রামের ভেতরেও একমাত্র কন্যা সন্তানের পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন ময়না। তার মেয়ে এবার এইচএসসি পাশ করেছে। ময়নার ইচ্ছে ছিলো মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। তাই নিজেই পরীক্ষা দিতে নিয়ে গিয়েছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ভর্তির সুযোগ না পাওয়ায় ময়না তাকে ফুলছড়ি উপজেলার সরকারী কলেজে বাংলা বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) কোর্সে ভর্তি করে দিয়েছেন। সন্তানের পড়াশোনা নিয়ে তাঁর কন্ঠে উচ্ছ্বাস ঝরে পড়লো। বললেন, “এতকিছুর ভেতরেও টুকটাক করে মেয়ের পড়া চালিয়ে গেছি। এখন সব জিনিসের দাম বাড়ছে। সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে গেছে। সেখানে পড়াশুনার খরচ চালানো তো আমাদের মতো গরীব মানুষদের জন্য খুবই কষ্টের। সরকারি কলেজে ভর্তি করাতে না পারলে মেয়েকে পড়াতে পারতাম না। ইচ্ছা আছে... ইনশাআল্লাহ, মেয়েকে এম এ পাশ করাবো।”
ময়না বলেন, “আমি গ্রামীণ ব্যাংক ও আশার কাছে চির কৃতজ্ঞ। এই প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে লোন না পেলে আমি আজকে এই অবস্থানে আসতে পারতাম না, স্বচ্ছলতার মুখ দেখতাম না। এখানে গ্রামীণ ব্যাংক, আশা, ব্র্যাকসহ বিভিন্ন এনজিও আছে যারা গ্রামের মহিলাদের সহজ কিস্তিতে ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে থাকে।”
শুধু ময়না নয়, এ গ্রামের আরো অনেক নারী, পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করেন। ইউনিয়ন পরিষদের মাটি কাটার কাজ, ফসলের মাঠে কাজ, জমিতে নিড়ানি দেয়া, রাস্তাঘাট তৈরির কাজেও নারীরা সমানভাবে অংশগ্রহণ করছে। এই অঞ্চলে গড়ে উঠেছে ঝরে পড়া চুল দিয়ে “হেয়ার ক্যাপ” তৈরির কারখানা। আনালের তারি গ্রামের অনেক নারীরাই এখন সেই চুলের ক্যাপের কারখানায় কাজ করেন। এক একটি ক্যাপ তৈরিতে পাওয়া যায় সাতশত থেকে আটশত টাকা। তবে মাটি কাটা, জমির কাজ ও অন্যান্য কাজে নারীদের মজুরি পুরুষের চেয়ে কম। একজন পুরুষ যেখানে দৈনিক মজুরি পান ৪৫০টাকা সেখানে একজন নারী পান দৈনিক ৩০০টাকা। অথচ নারী কোনো অংশেই পুরুষের চাইতে কম পরিশ্রম করেননা। এই চিত্র শুধু বাংলাদেশের একটা গ্রামের নয় বরং সারা বাংলাদেশের। গ্রামীন নারীদের কঠোর সংগ্রামের ছবিটি সব জায়গাতেই এক। যেখানে বিশ্বব্যপী জীবন যাত্রার মান বৃদ্ধি পেয়েছে সেখানে পুরুষের সঙ্গে কাধে কাধ মিলিয়ে কাজ করে এবং ক্ষেত্র বিশেষে বেশি পরিশ্রম করেও নারীর উপার্জন কম। অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের কাছে উপার্জনের স্বীকৃতিও মেলেনা ।
আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস:
বিশ্বের প্রায় চল্লিশটির বেশি দেশ প্রতিবছর ১৫ অক্টোবর আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস পালন করে। কৃষি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং খাদ্য নিরাপত্তা ও দারিদ্রতা দূরীকরণে গ্রামীন নারীদের ভূমিকাকে স্বীকৃতি দেয়ার লক্ষ্যে দিবসটি পালিত হয়। ১৯৯৫ সালে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হয় জাতিসংঘের ৪র্থ নারী সম্মেলন। সেই সম্মেলনে ১৫ অক্টোবর আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৯৯৭ সাল থেকে জেনেভাভিত্তিক আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা Women’s World Summit Foundation (WWSF) দিবসটি পালনের জন্য নেতৃত্ব দেয়। সংস্থাটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি পালন করে। এরপর ২০০৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় ৬২/১৩৬ নম্বর রেজ্যুলেশনের মধ্য দিয়ে ১৫ অক্টোবর আন্তর্জাতিকভাবে গ্রামীণ নারী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য: “গ্রামীন নারীরা বিশ্বব্যাপী জীবনযাত্রার ব্যয়-সংকটের মুখোমুখি।” (Rural women confront the global cost-of-living crisis.) জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, চরম দারিদ্র, ক্ষুধা ও অপুষ্টির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রেও লিঙ্গ সমতা আনয়ন এবং নারীর ক্ষমতায়ন প্রয়োজন। নারীদের পুরুষদের সমান সুযোগ দিলে বিশ্বের দরিদ্রতম অঞ্চলগুলোতে কৃষি উৎপাদন ২.৫ থেকে ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে এবং অপুষ্টিতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ১২ থেকে ১৭ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে। নারীরা জমি-জমা, গবাদি পশু ইত্যাদির মালিকানায়, বেতন ও দৈনিক মজুরির ক্ষেত্রে, পারিবারিক ও সামাজিক কাজে স্বিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হারে বৈষম্যের সম্মুখীন হয়। সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেনের যুদ্ধ শুধু সেখানকার নারীদের নয় বরং সারা বিশ্বের নারীদের ওপর, বিশেষ করে গ্রামীণ নারীদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। ইউএন উইমেনের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, খাদ্য ও এনার্জি মার্কেটের বর্তমান ভগ্নদশা লিঙ্গ বৈষম্যকে আরো তীব্র করেছে। যার ফলে বিশ্বে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, অপুষ্টি এবং দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। জীবনযাত্রার এই ব্যয়-সংকট নারীদের জীবিকা, স্বাস্থ্য এবং সুস্থতাকে তীব্রভাবে হুমকির মুখে ফেলেছে। যুদ্ধের প্রভাবে খাদ্য, জ্বালানি এবং সারের দামের পাশাপাশি তেল ও গ্যাস সরবরাহ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি, বাল্যবিবাহ, মেয়েদের স্কুল ছাড়তে বাধ্য করা, নারীর যত্নের অভাব এবং ঘরোয়া কাজের চাপ নারীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে আরও বিপন্ন করছে। তাই এবারের দিবসটিতে “গ্রামীন নারীরা বিশ্বব্যাপী জীবনযাত্রার ব্যয়-সংকটের মুখোমুখি” এই প্রতিপাদ্য নিয়ে গ্রামীণ নারীদের কাজের স্বীকৃতি ও সমান সুযোগ প্রদানের আহ্বান জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশে দিবসটি পালন:
বাংলাদেশে ২০০০ সাল থেকে প্রতি বছর দিবসটি পালিত হয়। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী ও উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) সম্পূর্ণ নিজেদের অর্থায়নে গ্রামীণ নারী দিবস উদযাপন করে আসছে। সারাদেশে র্যালি, সেমিনার, মানবন্ধন, সম্মাননা প্রদান সহ নানান কর্মসূচির আয়োজন করে সংগঠনগুলো। ফ্যামিলি টাইস ফর উইমেন ডেভেলাপমেন্ট নামক সেবা প্রদানকারী বেসরকারী সংস্থার নির্বাহী পরিচালক খুজিস্থা বেগম জোনাকী ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “গত আট বছর ধরে আমরা গ্রামীণ নারী দিবস পালন করে যাচ্ছি। আমরা মনে করি, গ্রামের নারীদের যে নীরব অবদান পরিবারে, সমাজে কিংবা রাষ্ট্রীয অর্থনীতিতে সেটির আসলে কোনো স্বীকৃতি নেই। নারীরা পরিবারের সকলের মুখে সবচেয়ে ভালো খাবারটি তুলে দেয় অথচ তারা পুষ্টিহীনতায় ভোগে। পাশাপাশি আরেকটি অ্যালার্মিং বিষয় হলো বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১১ হাজার নারী জরায়ু ক্যান্সারে মারা যায়। তাই গ্রামীণ নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য আমরা কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও সদর উপজেলার পাঁচ শতাধিক নারীর ভায়া টেস্ট করানো উদ্যোগ নিয়েছি। অক্টোবর মাসের শুরু থেকেই বিশদিন ব্যাপি আমরা একটি ক্যাম্পেইন করছি এবং আমাদের সহায়তা করছে ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’। আমরা শুধু ক্যাম্পেইন না ক্যাম্পও করছি। সরাসরি ভায়া টেস্ট করাচ্ছি।”