অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি: সুশীল সমাজের প্রতিক্রিয়া


ঢাকার একটি পেট্রোল পাম্প থেকে মোটর সাইকেলে তেল নিচ্ছেন একজন ক্রেতা। (ফাইল ফটো- রয়টার্স)
ঢাকার একটি পেট্রোল পাম্প থেকে মোটর সাইকেলে তেল নিচ্ছেন একজন ক্রেতা। (ফাইল ফটো- রয়টার্স)

বিশ্ব বাজারে দাম বাড়ার যুক্তি দেখিয়ে বাংলাদেশ সরকার গত ৫ আগস্ট রেকর্ড হারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করার পর ২৯ আগস্ট লিটারে পাঁচ টাকা কমিয়েছে। কিন্তু এরপরও সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম এখনও একশ টাকার বেশি।

এভাবে বিশাল ব্যবধানে দাম বাড়িয়ে ‘সামান্য’ পরিমাণে কমানোর পর মন্ত্রী-উপমন্ত্রীরা নানা যুক্তি তুলে ধরলেও ভয়েস অফ আমেরিকার কাছে জানানো প্রতিক্রিয়ায় সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন।

বাংলাদেশে ডিজেল ও কেরোসিনের লিটার এখন ১০৯ টাকা। ৫ আগস্টের আগে ছিল ৮০ টাকা। ১৩০ টাকা থেকে কমে পেট্রোল এখন ১২৫ টাকা। ৫ আগস্টের আগে ছিল ৮৬ টাকা। ১৩৫ টাকার অকটেন বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকায়। ৫ আগস্টের আগে দাম ছিল ৮৯ টাকা।

বাংলাদেশের ইতিহাসে একবারে এমনহারে দাম আগে কখনো বাড়ানো হয়নি। আইন অনুযায়ী পেট্রোলিয়াম পদার্থ, বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের মূল্যহার নির্ধারণ করার কথা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন-বিইআরসি’র। কিন্তু বাড়ানোর ঘোষণা এসেছে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে।

বিইআরসি’র চেয়ারম্যান মো. আব্দুল জলিল ১৭ আগস্ট ভয়েস অফ আমেরিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, জ্বালানি তেলের মূল্যহার নির্ধারণ করার আইনগত দায়িত্ব কমিশনের হলেও প্রবিধান চূড়ান্ত না হওয়ায় তারা করছেন না। তবে গ্যাস এবং বিদ্যুতের দাম তারা নির্ধারণ করে থাকেন।

অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ সরকারের জ্বালানি নীতির সমালোচনা করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরূল ইমাম ১০ আগস্ট ভয়েস অফ আমেরিকাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, বাংলাদেশ বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্তকে অবজ্ঞা করে নিজস্ব গ্যাসক্ষেত্রের অনুসন্ধানে না নামায় এই সংকট দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতির জন্য তিনি নিজস্ব গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে সরকারের একটি পক্ষের ‘ইচ্ছাকৃত অনীহাকে’ দায়ী করছেন।

এ পর্যায়ে ভয়েস অফ আমেরিকা কথা বলেছে সুশীল সমাজের কয়েকজন প্রতিনিধির সঙ্গে।

ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)
ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)

ড. ইফতেখারুজ্জামান
নির্বাহী পরিচালক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)

যখন আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম কম ছিল, তখন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান মূল্য না কমিয়ে লাভবান হয়েছে। এর ওপর আবার একলাফে ৫০ শতাংশ দাম বাড়িয়ে তার বিপরীতে লিটারে মাত্র পাঁচ টাকা কমানো হলো কিছুদিন আগে। এতে যাদের ওপর প্রভাব পড়েছিল, তাদের জন্য এই ঘোষণা সত্যিকার অর্থে উপহাস। কারণ বাংলাদেশে যেকোনো কিছুর মূল্য একবার বেড়ে গেলে সেটা কমার দৃষ্টান্ত খুবই বিরল।

জ্বালানি খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে গত মে মাসে আমরা সাতটি সুপারিশ করেছিলাম। তার কিছুই বাস্তবায়ন হতে দেখছি না। আমরা সবসময় গবেষণালব্ধ সুপারিশ পলিসি আকারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শেয়ার করি। এক্ষেত্রে আমরা সংসদীয় কমিটির সভাপতিসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যুক্ত করে সুপারিশমালা তাদের কাছে উপস্থাপন করেছি।

আমরা দেখেছি জ্বালানি-বিদ্যুৎ খাতের নীতিকাঠামো আসলে দখল হয়ে গেছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষার জন্যই অধিকাংশ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

অন্যদিকে প্রশ্ন তোলার ক্ষেত্রে আইনি বাধা আছে। ২০১০ সালে বিশেষ আইন করা হয়েছিল। এ খাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পর্কিত কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না। এ কারণে খাতটি জিম্মি অবস্থায় আছে। এজন্য এখানে জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী অনেক সিদ্ধান্ত গৃহীত হচ্ছে।

আমি মনে করি, খাতটি বিনিয়োগকারীদের কাছে এমনভাবে জিম্মি অবস্থায় আছে যে সেখান থেকে বের হওয়া কঠিন।

আমরা অন্য সুপারিশে বলেছি বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের সব পরিকল্পনা গ্রহণ করার আগে একটি জাতীয় নীতি-কাঠামো থাকতে হবে।

এ ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বার্থের সংঘাতে জড়ানো প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিতে দেখি আমরা।

এসব প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিদের পরিহার করে দেশের বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করা জরুরি। যথেষ্ট দক্ষ ব্যক্তি আমাদের দেশে আছেন। তাদের সংশ্লিষ্ট করে নীতিমালা গৃহীত হলে সেটা উপযোগী হবে।

আরেকটা পরামর্শ আমাদের সুপারিশে আছে। যে আইনটির কারণে সিদ্ধান্ত সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করা যায় না, সে আইন বাতিল করা উচিত। আমরা আশা করবো সরকার বিষয়টি বিবেচনায় নেবে।

ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক
ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক

ড. বদিউল আলম মজুমদার
সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক

মূল্যবৃদ্ধির এই হার অস্বাভাবিক। ইতিহাসে এভাবে কখনো দাম বাড়ানো হয়নি। এর পেছনে অবশ্যই বিশ্ববাজারের অস্থিরতা, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব রয়েছে। কিন্তু এখন দাম নিম্নমুখী। তারপরও বাংলাদেশে দাম বাড়ানো হলো।

ব্যাপক হারে বাড়ানোর আরেকটি বড় কারণ তেলখাতের ব্যাপক দুর্নীতি এবং লুটপাট। রাজনীতিবিদেরাই সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছেন। তাই রাজনৈতিক প্রভাবও পড়বে। যেভাবে সবকিছুর দাম বাড়ছে এর মাশুল কাউকে না কাউকে দিতে হবে।

দুর্নীতি এবং লুটপাটের কারণে এভাবে দাম বাড়ানো হলে সাধারণ মানুষ কেন তার মাশুল দিতে যাবে। আমাদের ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহিতার, স্বচ্ছতার অভাব প্রকট। সাধারণ মানুষের সেখানে মাশুল দেয়া উচিত না।

ড. মাহবুব উল্লাহ, অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক
ড. মাহবুব উল্লাহ, অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক

ড. মাহবুব উল্লাহ
অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম কমে গেলেও বাংলাদেশে সাধারণ মানুষকে বেশি দামে তেল কিনতে হয়। আবার মাঝে মাঝে সরকার অভিযোগ করে তারা প্রচুর ভর্তুকি দিচ্ছে। সেজন্য ভর্তুকি অবসানে ক্রেতা বা ভোক্তাদের ওপর দাম চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।

এবার বিভিন্ন গণমাধ্যমে জ্বালানি তেলের দাম সম্পর্কে যেটুকু তথ্য পেয়েছি, তাতে দেখা যায় জ্বালানি কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েক বছর ধরে টানা মুনাফা করেছে এবং মুনাফার অংকটি বেশ বড়। কিছুটা সমস্যা দেখা দিয়েছে চলতি বছরে।

এই মুহূর্তে এত দাম না বাড়িয়ে আরো বিকল্প ছিল। অথবা আরেকটু কম বাড়ানো যেত; অথবা না বাড়ালেও চলতো।

এবার দাম বাড়ানোর আগে কোনো গণশুনানি হয়নি। ফলে ব্যাপারটার মধ্যে এক ধরনের বেআইনি প্রক্রিয়া রয়ে গেছে।

জ্বালানি তেলের দাম অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। তাই আরও ভেবেচিন্তে দাম বাড়ানো উচিত ছিল।

ভবিষ্যতে একটা উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে। যখন দাম পড়তির দিকে থাকবে, তখন গড়ের সঙ্গে সমন্বয় করা যেতে পারে। দাম আবার বাড়লে একইভাবে স্থিতি ঠিক করা যেতে পারে। এটা যদি করা হয় তাহলে কোনো অভিযোগ আসবে না।

প্রায় ৫০ শতাংশ দাম বাড়িয়ে লিটারে সম্প্রতি পাঁচ টাকা কমানো হলো। সবাই এটাকে এক ধরনের ‘মশকরা’ বলছেন। অনেকে এটাও বলছেন ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’ দেওয়া হয়েছে।

মানুষের কষ্ট অনেক বেশি। কিন্তু সে তুলনায় উপশম করার জন্য যে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে সেটা খুবই সামান্য।

মাহা মির্জা, উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়ক গবেষক
মাহা মির্জা, উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়ক গবেষক

মাহা মির্জা
উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়ক গবেষক

দাম বাড়ানোর যুক্তি দিতে গিয়ে এখন হঠাৎ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু দাম বাড়ানোর বিষয়টা আজকে নতুন না। আমরা ধারাবাহিকভাবে দেখছি যে গত ১০ বছরে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম, গ্যাসের দাম, পেট্রোলের দাম বাড়ানো হয়েছে। সরকার দাম বাড়ানোর মধ্যেই আছে।

অনেকে বিষয়টিকে সরকারের ‘ভুলনীতি’ বললেও আমি ‘ভুল’ বলতে চাই না। কারণ প্রথম থেকেই সরকার খুব ইচ্ছাকৃতভাবে এই পথে হেঁটেছে।

যেসব পলিসি গ্রহণ করলে দাম বাড়ানোর বাধ্যবাধকতা চলে আসে, বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তার পরেও সেই পলিসিই নেওয়া হয়েছে। এজন্য বলছি, দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হঠাৎ কিংবা নতুন কিছু নয়।

গণমাধ্যমের তথ্য বলছে, এর আগে বিপিসি দীর্ঘদিন লাভ করেছে। লাভের অংকটা প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো। একটা বিশাল পরিমাণে লাভ করে বিভিন্ন ব্যাংকে রেখেছে তারা। কিন্তু সেখান থেকে যে সুবিধা জনগণের পাওয়ার কথা ছিল, তা এখন পাওয়া যাচ্ছে না। লাভের তহবিল থেকে সমন্বয় করা হবে-সেটাই নিয়ম। এটা না করলে লাভটা তাহলে কার জন্য করা হলো?

আগের লাভ থেকে সমন্বয় না করে এখন যে পাঁচ টাকা কমানো হলো, এটা এক ধরনের প্রতারণা।

জনগণের থেকে বেশি টাকা হাতিয়ে নিয়ে পরে কোনো হিসাব দেওয়া হয় না। কোনো ধরনের জবাবদিহিতাও নেই। এভাবে দফায় দফায় দাম বৃদ্ধি করে অর্থনীতিকে একটা নাজুক অবস্থায় নেওয়া হয়েছে। এই চক্রটা এখন কমন হয়ে গেছে।

XS
SM
MD
LG