ঋতুচক্র অনুযায়ী সময়টা বর্ষাকাল। এ সময়ের আবহাওয়ার চরিত্র হচ্ছে ভ্যাপসা গরম।তার সাথে আছে যখন তখন বৃষ্টি। এরকম আবহাওয়াতে নানা ধরণের রোগব্যাধি বাড়তে দেখা যায়।কোন কোন রোগের প্রকোপ এ সময়ে তীব্র হয়ে ওঠে।ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ এ সময় বাড়তে শুরু করে।আবার বিভিন্ন জায়গায় জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়তে শুরু করে, তাই বৃদ্ধি পায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা।
স্বাস্থ্য পরিস্থিতির সাম্প্রতিক চিত্র
রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় এখন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।সম্প্রতি সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও, বিভিন্ন উপজেলায় পানিবাহিত রোগ দেখা দিয়েছে।সিলেট সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী ২৮ জুন পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডায়রিয়া আক্রান্তহয়ে ৪৮জন রোগী চিকিৎসাধীন ছিলেন। এর মধ্যে ১৫ জনই শিশু। জুনের শেষ নাগাদ এক সপ্তাহে জেলার ১১টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২১৯ জন ডায়রিয়া রোগী চিকিৎসা নিয়েছে।পাশাপাশি বাড়ছে চর্মরোগে আক্রান্তের সংখ্যাও।
এদিকে, প্রতিদিন বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী
১ জানুয়ারি থেকে ২৩ জুলাই ২০২২ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট দুই হাজার ৮১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে, ঢাকায় এক হাজার ৭৭৮ জন ও ঢাকার বাইরে ভর্তি হয়েছেন ৩০৩ জন ডেঙ্গু রোগী।
অন্যদিকে, চিকিৎসা শেষে এক হাজার ৭৫৬ জন হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। এদের মধ্যে এক হাজার ৫১৪ জন ঢাকার বাসিন্দা, বাকি ২৪২ জন ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলার বাসিন্দা।
শুরু হয়েছে করোনার চতুর্থ ঢেউ। প্রতিদিন বাড়ছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যাও। দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া নতুন করে ৪৪৬ জনের শরীরে এই ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে দেশে এখন পর্যন্ত করোনায় মৃতের সংখ্যা ২৯ হাজার ২৬২ জন এবং শনাক্তের সংখ্যা ২০ লাখ এক হাজার ৩৪৫ জনে পৌঁছেছে।
শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর করোনা বিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানিয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় চার হাজার ৪১৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে।
এ সময় শনাক্তের হার ১০ দশমিক ১০ শতাংশ। মোট পরীক্ষায় এ পর্যন্ত শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় মোট মৃত্যুর হার এক দশমিক ৪৬ শতাংশ।
এ সময়ের অসুখ-বিসুখ ও সতর্কতা
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের মেডিক্যাল অফিসার ডা. তাজিন জান্নাত বললেন, “এই সময়ে প্রচন্ড গরম ও ভ্যাপসা আবহাওয়ার কারণে হিটস্ট্রোক, ডিহাইড্রেশন, ডায়রিয়া, কলেরা, জন্ডিস, টাইফয়েডসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ, পেটের পীড়া দেখা দেয়। এ সিজনে ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়ে থাকে। জ্বর, সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হতে পারে যে কেউ। অতিরিক্ত গরম আবহাওয়া থেকে ঘেমে ঠান্ডা লাগতে পারে। সে কারণে অনেকে জ্বর, সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েন।”
“এমন পরিস্থিতিতে, বাইরের খাবার,বাসি খাবার, চার/পাঁচ ঘন্টা আগে থেকে রান্না করা খাবার,প্রসেস ফুড না খাওয়াই ভালো।এই আবহাওয়ায়, এ ধরণের খাবারে খুব সহজেই ব্যাকটেরিয়া জন্মায়।এসব খাবার খেলে, পেটের পীড়া, ডায়রিয়া, আমাশয়, কলেরা, জন্ডিস, টাইফয়েড ইত্যাদি পানিবাহিত রোগ হতে পারে; জানান ডা. তাজিন জান্নাত।
তিনি বলেন, “ডায়েবেটিস, কিডনির সমস্যা, হাইপারটেনশন যাদের আছে তাদের এ আবহাওয়াতে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হয়। অতিরিক্ত ঘামের ফলে, শরীরে লবনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দিতে পারে।তাই পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি, মৌসুমী ফল খেতে হবে এমন স্বাস্থ্য সমস্যা যাদের রয়েছে।শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিলে স্যালাইন খেতে হবে।শরীরে লবনের ভারসাম্যহীনতা,অর্থাৎ ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালেন্স দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।”
হিটস্ট্রোক সম্পর্কে ডা. তাজিন জানালেন, “শরীরের তাপমাত্রা ১০৪ ডিগ্রি বা তার বেশি হয়ে গেলে, শরীরের রক্তচাপ কমে মানুষ অচেতন হয়ে পড়তে পারে।মস্তিষ্কের যে অংশ শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, তা শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।আবার তীব্র গরমে অনেকক্ষণ পরিশ্রম করলে, অনেকক্ষণ রোদের তাপে থাকলে, শরীরে পানিশূন্যতা তৈরি হয়ে তাপমাত্রা বেড়ে যেতে পারে। এটাই হিট স্ট্রোক।হিট স্ট্রোকের লক্ষণ হলো মাথা ঘোরা, চোখে ঝাপসা দেখা, শরীর অস্বাভাবিক রকমের দুর্বল ও অসাড় হয়ে যাওয়া।এরকম লক্ষণ দেখা দিলে আক্রান্ত ব্যক্তিকে ঠান্ডা স্থানে নিয়ে আসতে হবে। ঠান্ডা পানি, স্যালাইন খাওয়াতে হবে। চেষ্টা করতে হবে যাতে শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত নেমে আসে। যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।”
ডা. তাজিনের মতে, “শিশুদের আবহাওয়া উপযোগী সুতি নরম কাপড়ের জামা পরাতে হবে যাতে শিশু ঘেমে না যায়।অনেকে গরমকালে শিশুদের শরীরে ট্যালকম পাউডার ব্যবহার করে। এটা ব্যবহার করা উচিত নয়।পাউডার ত্বকের ঘর্মগ্রন্থিগুলোকে বন্ধ করে দেয়। ফলে শরীর থেকে ঘাম বের হতে পারে না।এর ফলে, ঘামাচিসহ অন্যান্য চর্মরোগ দেখা দিতে পারে। শিশুদের প্রতিদিন গোসল করাতে হবে।শিশুদের বাইরের খাবার দেয়া একদম উচিত নয়। বাসায় তৈরি সহজপাচ্য ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে।”
“এই সময় বৃষ্টির কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যায়।এডিস মশার কামড় থেকে রক্ষা পেতে মশারী টাঙিয়ে ঘুমাতে হবে।এছাড়া বাড়ির আনাচে কানাচে এসির পানি, বৃষ্টির পানি, ফুলের টবে যাতে পানি জমে না থাকে সে ব্যাপারে সতর্কথাকতে হবে; জানান ডা. তাজিন।
তিনি বলেন, “যেহেতু প্রতিদিন করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, তাই এ ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে।পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক পরা, সাবান বা হ্যান্ড ওয়াশ দিয়ে বারবার হাত ধোয়া, বাইরে থেকে বাসায় আসার পর, পরিধেয় কাপড়চোপড় সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলাসহ সকল সতর্কতা মেনে চলতে হবে।”
সুস্থ থাকতে করণীয়:
এভারকেয়ার হাসপাতালের প্রিন্সিপাল ডায়টেশিয়ান তামান্না চৌধুরী ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন:
গরমে সুস্থ থাকার জন্য বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের ব্যাপারে বিশেষ জোর দিতে হবে। এই গরমে সুস্থ থাকার জন্য পানি খাওয়ার উপরে জোর দিতে হবে। বাইরে গেলে সবসময় বাসা থেকে আনা বিশুদ্ধ পানির বোতল সঙ্গে রাখতে হবে। কারণ এখন অনেক বেশি কলেরা, ডায়রিয়া দেখা দিচ্ছে, আর ডায়রিয়ার জীবানুর অন্যতম মাধ্যম দুষিত পানি। এছাড়া, গরমের কারণে ঘামের সাথে প্রয়োজনীয় খনিজ বেরিয়ে যায়। কম পানি খেলে শরীরে পানিস্বল্পতা দেখা দেয়। তা রোধ করতে হবে। পানি কম খেলে শরীরে টক্সিসিটি বাড়ে, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
সহজপাচ্য খাবার খেতে হবে। তরল খাবার, স্যুপ জাতীয় খাবার বেশি খেতে হবে।
মাংসের বদলে মাছ বেশি খেতে হবে। কেননা, মাংস হজমে সময় বেশি লাগে। তাছাড়া, বাঙালী রীতিতে মাংস রান্নায় তেল মসলার ব্যবহার বেশি হয়। মাছ কম সময়ে কম মসলায় রান্না করা যায়। তাই মাছ খাওয়া উত্তম।
তেল, মশলা, ভাজা খাবার কম খাওয়া উচিৎ।
চা, কফি কম খেতে হবে। বদলে, প্রতিদিন ডাবের পানি, তাজা ফলের রস (চিনি ছাড়া) খাওয়া ভালো।এসব পানীয় শরীরকে ঠান্ডা রাখে।
ডা. তাজিন জান্নাত বললেন:
ডিহাইড্রেশন, হিটস্ট্রোক থেকে রক্ষা পেতে, বাসা থেকে বাইরে বের হলে, বিশুদ্ধ খাবার পানি, ছাতা, সানগ্লাস ব্যবহার করতে হবে।
বাইরের রেডিমেড খাবার, রাস্তার খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। যেমন; সিঙ্গারা-সমুচা, তেলের খাবার, চটপটি-ফুচকার মত খাবার; না খাওয়া ভাল।
প্রতিদিন গোসল করা, বারবার হাত-পা ও মুখ ধোয়া; বিশেষ করে বাইরে থেকে বাসায় আসার পর ভালোভাবে হাত-পা, মুখ পরিস্কার করতে হবে।
ঘর ঠান্ডা রাখতে, ঘরে ভারী পর্দার ব্যবহার করতে হবে।
যতটা সম্ভব তীব্র রোদে না থাকার চেষ্টা করতে হবে।