অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

বাংলাদেশে ড্রাগন ফল চাষে সাফল্য ও সম্ভাবনা


ড্রাগন ফ্রুট বা পিটায়া ফল।
ড্রাগন ফ্রুট বা পিটায়া ফল।

বাংলাদেশের নাটোর জেলার সবচেয়ে বড় ড্রাগন ফল চাষী মোহাম্মদ গোলাম নবী। নাটোর সদর উপজেলার মাঝদিঘা গ্রামে তিনি গড়ে তুলেছেন ‘নাটোর ড্রাগন ফ্রুট গার্ডেন’’। এ বাগানে পাঁচ হাজার পিলারে বিশ হাজার গাছে ড্রাগন উৎপন্ন হয়। ২০১৪ সালে প্রায় ১০ একর জায়গায় তিনি প্রকল্পটি শুরু করেন। ড্রাগন চাষের আয়ে তিনি সন্তুষ্ট। এবার প্রতি লটে আট থেকে দশ টন ফল সংগ্রহ করেছেন তিনি ।

মাগুরা জেলার কুচিয়ামোড়া ইউনিয়নের গাংনী গ্রামের গাবতলা বাজারে অবস্থিত ‘বেস্ট এগ্রো ফার্মস’’। স্বত্বাধিকারী ইজাজুল হক রিজু ২০১৮ সালে গড়ে তোলেন বাগানটি। বাগানের বিশ বিঘা জমিতে ড্রাগন ফলের চাষ হচ্ছে । এই বাগানে এখন দুই হাজার চারশ’ পিলারে মোট নয় হাজার ছয়শ’টি গাছ রয়েছে।

ইজাজুল হক রিজু জানালেন যে, গত বছর বাগান থেকে প্রায় ত্রিশ লক্ষ টাকার ড্রাগন ফল বিক্রি করেছেন তিনি।

বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরেই বিদেশী ফলের চাষ হচ্ছে। যে সব ফলের আদিবাস এ ভূখন্ডে নয়, এখানকার জলবায়ুর সাথেও ফলের উৎপাদনের প্রয়োজনীয় জলবায়ুর মিল নেই; সে ফলগুলোকে জলবায়ুর সাথে খাপ খাইয়ে চাষাবাদ করাটাই মূলত বিদেশী ফলের চাষ। আর ড্রাগন বাংলাদেশে এখন বেশ জনপ্রিয় ফল। ২০০৭ সালে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম চাষের জন্য থ্যাইল্যান্ড, ফ্লোরিডা ও ভিয়েতনাম থেকে বিভিন্ন জাতের ড্রাগন ফল আনা হয়।

ড্রাগন ফল

ড্রাগন মূলত মধ্য আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার প্রসিদ্ধ ফল। বিশেষ করে, মেক্সিকো ও ফ্লোরিডাতে এর ফলন হতো। পরবর্তীকালে, পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ; তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া এবং সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ এর চাষ শুরু হয়। এছাড়া, ইসরায়েল, উত্তর অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ চীনেও ড্রাগন পাওয়া যায়। এটি একটি ক্যাকটাস প্রজাতির গাছ। এই গাছ সাধারনত দেড় থেকে আড়াই মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়।

প্রজাতি: বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়ার সঙ্গে ড্রাগন গাছ খাপ খেয়ে গেছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সিটিউট (বারি) উদ্ভাবিত ড্রগন ফলের নতুন জাত ‘বারি ড্রাগন ফল-১’। এ জাতটি দক্ষিণ -পূর্ব এশিয়াতে জনপ্রিয় ফল। এ ফলের আকার বড়।পাকলে খোসার রং লাল হয়। শাঁস গাঢ় গোলাপী রঙের এবং রসালো হয়। ফলের বীজ ছোট ছোট কালো জিরার মতো । একটি ফলের ওজন ১৫০ গ্রাম থেকে ৬০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশে তিন প্রজাতির ড্রাগন ফল দেখতে পাওয়া যায়।

  • পিটাইয়া বা লাল ড্রাগন ফল। খোসার রঙ লাল ও শাঁস সাদা।
  • কোস্টারিকা । খোসা ও শাঁস উভয়ের রঙই লাল।
  • হলুদ রঙের ড্রাগন। এই জাতের ফলের খোসা হলুদ রঙের ও শাঁসের রঙ সাদা।

বাংলাদেশে উদ্ভাবিত জাতগুলো মূলত কোস্টারিকা ও পিটাইয়া জাত মিলিয়ে তৈরি। বাংলাদেশে উদ্ভাবিত জাতগুলো হলো; বারি ড্রাগন ফল-১, বাউ ড্রাগন ফল-১ (সাদা) ,বাউ ড্রাগন ফল-২ ( লাল ), বাউ ড্রাগন ফল-৩।

পুষ্টিগুণ: এভারকেয়ার হাসপাতালের প্রিন্সিপাল ডায়টেশিয়ান তামান্না চৌধুরী ড্রাগন ফলের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে বলেন,“ড্রাগন রোগ প্রতিরোধে কার্যকর। ক্যারোটিন সমৃদ্ধ হওয়ায় চোখের জন্য ভালো। আঁশের পরিমাণ বেশি থাকায় হজমে সহায়তা করে। ফলে বিদ্যমান প্রোটিন শরীরের যাবতীয় বিপাকীয় কাজে সহায়তা করে। এর ক্যালসিয়াম হাড় শক্ত ও দাঁত মজবুত রাখে। রক্তের কোলেস্টেরল কমাতে এবং ত্বক মসৃণ রাখতে সাহায্য করে এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। ড্রাগন ফল আয়রণ সমৃদ্ধ। যাদের রক্তে আয়রণের ঘাটতি আছে তাদের জন্য এই ফল উপকারী।”

কিভাবে খাওয়া যেতে পারে: লাল জাতের ড্রাগন ফল এমনিতেই মিষ্টি ও সুস্বাদু। খোসা ছাড়িয়ে তাজা ফল খাওয়াই ভালো। এছাড়া, ড্রাগন ফলের জুস, স্মুদি, মিল্কশেক বানিয়ে খাওয়া যেতে পারে। কাস্টার্ড, ফালুদা তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। স্বাস্থ্যকর রেসিপি হিসেবে টকদই, চিয়া-সিডস, ওটসের সাথে মিশিয়েও খাওয়া যেতে পারে।

বাংলাদেশে ড্রাগন ফলের চাষ

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক ও বর্তমানে বরিশালের রহমতপুরের এগ্রিকালচার ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (এটিআই)-এর অধ্যক্ষ সুশান্ত কুমার প্রামাণিক বাংলাদেশে ড্রাগন ফলের চাষ নিয়ে কথা বলেন ভয়েস অফ আমেরিকার সঙ্গে।

তিনি বলেন, “এখন থেকে প্রায় আট-দশ বছর আগে থেকেই ড্রাগন চাষ শুরু হয়েছে। এখানে থাইল্যান্ডের জাত ও আমাদের দেশীয় উদ্ভাবিত জাতের ড্রাগন ফলের চাষ বেশি হচ্ছে। দিন দিন কৃষকরা এর বানিজ্যিক উৎপাদনে আগ্রহী হচ্ছে। মানুষ এই ফলের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন। ড্রাগন ফল প্রচুর এন্টি অক্সিডেন্ট, ভিটামিন ও খনিজে ভরপুর। একটু উঁচু ও উর্বর জমিতে এর ফলন ভালো হয়। ড্রাগন চাষে অর্গানিক ম্যাটার বেশি দিতে হয়, তাহলে ফল খুব দ্রুত বাড়ে। আমাদের দেশের ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, মাগুরায়, উত্তরবঙ্গের রাজশাহী,বগুড়া, নাটোরে ড্রাগন ফলের ব্যাপক চাষ হচ্ছে। এমনকি পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতেও ড্রাগনের চাষ হচ্ছে ।

“এই ফলের চাষ করে , কৃষকরা আর্থিকভাবে বেশ লাভবান হচ্ছেন। সারাদেশে ড্রাগন উৎপাদনের পরিমাপ প্রতি হেক্টরে ৩০ থেকে ৩২ টন। ড্রাগন ফল সাধারণত মে মাস থেকে শুরু করে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত উৎপাদিত হয়। বছরে তিনবার ফল সংগ্রহ করা হয়। সম্প্রতি বরিশাল অঞ্চলেও চাষ শুরু হয়েছে। আশা করি খুব শীঘ্রই সেখানকার চাষে সফলতা আসবে। আমরা ড্রাগনের বিভিন্ন জাত এখানকার কৃষকদের সরবরাহ করছি;” জানান সুশান্ত কুমার প্রামাণিক।

সুশান্ত কুমার প্রামাণিক আরো বলেন, “ড্রাগন চাষের ভালো দিক হলো আমাদের দেশের তরুণ উদ্যোক্তারা এগিয়ে এসেছেন। তবে প্রাথমিক খরচটা বেশি হচ্ছে। বাগানের মাটি তৈরি, পিলার তৈরি চারা তৈরি ও রোপনসহ বেশ কিছু খরচ উদ্যোক্তাদের হয়।যদি এর জন্য ব্যাংকগুলোতে কৃষিঋণ সুবিধা বাড়ানো হয় ও স্বল্প সুদে ঋণ দেয়া হয়, তাহলে উদ্যোক্তারা আরো বেশি লাভবান হবেন এবং ড্রাগনসহ অন্যান্য বিদেশি ফল চাষে আগ্রহী হবেন।”

তিনি বলেন, “এটা হলে, তরুন সমাজের একটা বড় অংশ চাষাবাদে এগিয়ে আসবে। অনেক লোকের কর্মসংস্থান হবে। ব্যবসায়িক কৃষি প্রতিষ্ঠিত হবে। আমরা কৃষকদের বিদেশী ফল এবং সেগুলো চাষাবাদের সাথে পরিচিতি ঘটানোর জন্য প্রশিক্ষণ দেই, উপযোগিতা সম্পর্কে বোঝাই। ফলের জাতগুলো সম্পর্কে জানাই। কোন জাত কিভাবে চাষাবাদ করতে হবে সেগুলো তাদের জানাই এবং চাষাবাদের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত সুবিধা প্রদান করি। বিভিন্ন প্রকল্প থেকে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে থাকি, যাতে কৃষকরা বুঝতে পারেন কিভাবে উৎপাদন করতে হয়।”

বাজারে ড্রাগন ফলের দাম: রাজধানী ঢাকার কারওয়ান বাজার ও মোহাম্মদপুরের খুচরা বাজারে দেশি লাল জাতের ড্রাগন ফল বিক্রি হচ্ছে, আকার ভেদে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি দরে। তবে, কিছু ড্রাগন ফল বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা দরে। খোসার রং ফ্যাকাশে গোলাপী এবং শাঁস সাদা থাই জাতের ড্রাগন ফলের দাম তুলনামুলক কম। এই ফল আকারে বড় হলেও কিছুটা কম সুস্বাদু।

বাগান মালিকরা জানালেন, “গত বছর লকডাউনে তাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে লকডাউনের বিধিনিষেধ ও পরিবহন সংকটের কারণে আড়তদারদের কাছে মাত্র ১০০টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে হয়েছিলো। এ বছর ফলের মৌসুমে দাম ভালো পাচ্ছেন। বড় সাইজের ফল পাইকারি বাজারে গড়পরতা ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

মোহাম্মদপুর কৃষিমার্কেটে মো. সালাম তার স্ত্রী ও সাত বছরের ছেলেকে নিয়ে বাজার করতে এসেছেন। ড্রাগন ফল দেখে ছেলে কেনার আবদার করছে। ফল কিনছেন কি না জিজ্ঞেস করতেই বললেন, “আগে কখনও এই বিদেশি ফল কিনিনি। এই ফলটা দেখতে অনেক সুন্দর কিন্তু দাম তো বেশি। ছেলে আবদার করলো, আধা কেজি কিনে দেখি।”’’

ঢাকার রাস্তাঘাটে মৌসুমী ফলগুলো রিক্সাভ্যানে করে বিক্রি করার চিত্র খুবই পরিচিত। এবছর দেখা গেল ভ্যানে বিক্রি হচ্ছে ড্রাগন ফলও। রিকশাচালক হাসান এরকম একটা ভ্যান থেকে ড্রাগন ফল কিনছিলেন। বললেন, “এই ফল তো খাইতে অনেক মজা। আমার ভালো লাগে। শুনছি অনেক পুষ্টি। ৪০ টাকা দিয়ে এক পিস কিনলাম।”’

মিসেস রেবেকা থাকেন ধানমন্ডিতে। তার বাসায় সবাই ড্রাগন ফল খেতে পছন্দ করে। ড্রাগন ফলের চাষ করে এমন এক বাগানের ফলের তিনি নিয়মিত ক্রেতা। ফল আসলেই তাঁকে জানানো হয়। তিনি পরিমাণ বলেন, সেই অনুযায়ী তাঁর বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। সিজনে বাজারে তো পাওয়া যায়, তাহলে এভাবে কেন ড্রাগন ফল কেনেন, জানতে চাইলে বলেন, “সরাসরি বাগান মালিকদের কাছ থেকে ফল নিলে, সেটা টাটকা হয়। ফলের স্বাদ ভালো হয়। সবচেয়ে বড় কথা, রাসায়নিকমুক্ত হয়, তাই নিশ্চিন্তে খেতে পারি। এছাড়া, ফলের সাইজগুলো বড় হয়। ফলের দাম কেজি প্রতি ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা পড়লেও, এভাবেই কিনি।

ড্রাগন চাষে সাফল্য

নাটোর ড্রাগন ফ্রুট গার্ডেন: নাটোর ড্রাগন ফ্রুট গার্ডেনের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ গোলাম নবী ভয়েস অফ আমেরিকাকে বললেন তার ড্রাগন ফল চাষের গল্প।

তিনি বলেন, “আমি যখন শুরু করি তখন উদ্যান কৃষি (হর্টিকালচার) থেকে আমাকে একশ চারা ও চল্লিশটি পিলার দিয়েছিল। তখন আমরা কেউ আসলে এই ফলের চাষাবাদ সম্পর্কে তেমন কিছু জানতাম না। ইন্টারনেট ঘাটতে শুরু করি। ফল সম্পর্কে, এর চাষাবাদ সম্পর্কে জানতে শুরু করলাম। জানলাম, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ড্রাগন উৎপাদিত হয় ভিয়েতনামে। সব বড় বড় বাগানগুলো ওখানেই আছে। ওদের চাষাবাদ ও উৎপাদন সংক্রান্ত সকল তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করলাম। জানলাম এটা একটা দীর্ঘমেয়াদী ফসল। আমাদের ভেতর তখন ড্রাগন ফল চাষের একটা আগ্রহ দেখা দিলো। সে সময় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যান বিভাগের অধ্যাপক ড. এম. এ. রহিম আমাদের প্রজেক্ট দেখতে আসেন। তিনি আমাকে ভিয়েতনাম নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেন। সেখানে ড্রাগন ফলের বিভিন্ন প্রজেক্ট ঘুরে তাদের কাজ দেখি এবং সেখান থেকে কয়েক প্রজাতির চারা নিয়ে আসি। এখানে এসে বাগানের আম গাছ সহ অন্যান্য ফলের গাছগুলো কেটে ফেলি এবং ড্রাগনের জন্য মাটি তৈরি করি। প্রায় পঞ্চাশ-ষাটজন লোক, ছয়-সাত মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করে বাগানে পিলারগুলো তৈরি করি। আমেরিকার ফ্লোরিডার লাল জাতের ড্রাগনের চারা থেকে জাত তৈরি করে আমরা সেটার চাষ শুরু করি। ভিয়েতনামের গোলাপি জাতের ড্রাগনের চাইতে এর স্বাদ ভালো। এক বছরের মাথায় ফল উৎপাদন শুরু হয়। ২০১৬ সাল থেকে বানিজ্যিকভাবে আমাদের ড্রাগন ফলের উৎপাদন শুরু হয়।”

সে সময় ড্রাগন ফলের বাজার তৈরির লক্ষ্যে, নাটোর ড্রাগন ফ্রুট গার্ডেন’ থেকে প্রচুর চারা চাষীদের কাছে কমমূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। গোলাম নবীর এই ফলের বাগানে , ১৫জন কর্মী সবসময় কাজ করেন। তবে ফল সংগ্রহের মৌসুমে ৩০ থেকে ৪০ জন অতিরিক্ত কর্মী কাজ করেন। ফল সংগ্রহ, প্যাকেজিং থেকে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে কাজের জন্য বাড়তি লোকের প্রয়োজন হয় তখন।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা তাঁর বাগান থেকে ফল কিনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করেন। গোলাম নবী মনে করেন, ড্রাগন ফলের দাম এমন হওয়া উচিৎ, যাতে সাধারণ মানুষ তা কিনে খেতে পারে। অত্যন্ত পুষ্টিকর এই ফলের চাষ যত বেশি হবে, ততই বাজারে সরবরাহ বাড়বে, দাম কমবে এবং সাধারণ মানুষ তা কিনে খেতে পারবে।

গোলাম নবীর বাগান দেখে উৎসাহিত হয়ে পুরো নাটোর জেলায় অনেক চাষী এখন ড্রাগন ফল উৎপাদন করছেন। নাটোর এবং আশেপাশের জেলাগুলোতে এখন শ’খানেক ড্রাগন ফলের বাগান গড়ে উঠেছে। আরও চাষী ড্রাগন চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। ফলের পাশাপাশি, ভালো জাতের ড্রাগন ফলের চারাও প্রচুর বিক্রি করছেন বলে জানালেন গোলাম নবী। তিনি বলেন, “ড্রাগন ফলের পাশাপাশি সৌদি খেজুরের চাষ শুরু করেছি। এবারই প্রথম তা বাজারজাত করতে যাচ্ছি।”

মাগুরার বেস্ট এগ্রো ফার্ম

বেস্ট এগ্রো ফার্মের বাগানের আয়তন আট একর। বাগানে ড্রাগন ফলের পাশাপাশি চাষ হচ্ছে সৌদি খেজুর, মালটা, বলসুন্দরী বরই, থাই পেয়ারা।

বাগান মালিক ইজাজুল হক রিজু বললেন, “পারিবারিক এই জমিটি পড়ে ছিলো। তেমন কোনো চাষাবাদ হতো না। আমরা এখানে ড্রাগন ফলের চাষ শুরু করি। পরে সৌদি খেজুর, মালটাসহ অন্যান্য ফলের বাগান করি।”

রিজু জানালেন, তাঁদের বাগানে নিয়মিত পনেরো জন কর্মী রয়েছেন। ফলের মৌসুমে স্থানীয় আরো লোকজন বাগানে কাজ করে থাকেন। ফল বিক্রির পাশাপাশি বেস্ট এগ্রো ফার্মস থেকে ফলের চারা তৈরি করে বিক্রি করা হচ্ছে। খামারিরা এখান থেকে ড্রাগন, মালটা ও খেজুরের চারা কিনেন।

“অনেকে এখন ছাদবাগানেও ড্রাগন চাষ করছেন। তারাও চারা কিনে নিয়ে যান। চারা রোপন ও চাষাবাদ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় পরামর্শও এ বাগান থেকে প্রদান করা হয়। রাজধানী ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশেই ফরমালিনমুক্ত ফল সরবরাহ করা হয়। এ অঞ্চলে আশেপাশে আর এমন বাগান নেই। তাই ফলের মৌসুমে দূর দূরান্ত থেকে লোকজন বাগান দেখতে আসে; জানালেন ইজাজুল হক রিজু।’

ড্রাগন চাষে প্রতিবন্ধকতা সম্ভাবন

ইজাজুল হক রিজু জানান, “ড্রাগন নিঃসন্দেহে একটি অর্থকরী ফল। মৌসুমে, যখন ফল পাকার সময় হয়, তখন সব বাগানে একসাথে পাকতে শুরু করে। ফলে একসাথেই সব ফল বাজারে আসে। যার ফলে খামারিরা ফলের নায্য মূল্য পান না। ফল সংক্ষণের কোনো ব্যবস্থাও নেই। আমাদের দেশে ড্রাগন ফলে কোনো প্রিজারভেশন ব্যবহার করা হয় না, তাই চার দিনের মাথায় ফল নষ্ট হয়ে যায়। সরকারি উদ্যোগে জেলায় জেলায় ফল হিমায়িতকরণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ কৃষি বিভাগ এ ধরণের সংক্ষণ পদ্ধতির ব্যবস্থা করতে পারে। তাহলে, মৌসুম শেষেও ফল বিক্রি করা যেতো এবং খামারিরা লাভবান হতেন।”

তিনি বলেন, “আমাদের দেশে থাইল্যান্ড বা ভিয়েতনাম থেকে যে ড্রাগন ফল আমদানিহয়,সুপারশপগুলোতে ঐ ফলগুলো বেশ চড়া দামে বিক্রি হয়। সেগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও প্যাকিং হয়েই আসে। আমরা যদি আমাদের উৎপাদিত ফল সংরক্ষণ করতে পারতাম, তাহলে আমাদের ফলও বিদেশে যেতো। আমাদের দেশে উৎপাদিত ড্রাগনের যেহেতু স্বাদ খুব ভালো, তাই রপ্তানি করা গেলে এর চাহিদাও বাড়তো।”

একই কথা বললেন নাটোরের মোহাম্মদ গোলাম নবী। জানালেন, “ফলের উৎপাদন যখন সারাদেশে বৃদ্ধি পাবে তখন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা তৈরি হবে। দেশের বাইরে ফল রপ্তানির উদ্যোগ না নিলে উৎপাদিত ড্রাগন ফল নষ্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। যেসব দেশে ড্রাগন উপাদন হয় না, সেসব দেশে ড্রাগন ফল রপ্তানির উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। আমাদের দেশে উৎপাদিত ড্রাগনের জাত অনেক ভালো। এমনকি ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডে উৎপাদিত ড্রাগনের চেয়ে এটি অনেক বেশি সুস্বাদু। তাই এই ফলটি বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করতে পারলে বাগান মালিকরা লাভবান হতো।”

তিনি আরো বলেন, “ফল সংরক্ষণের জন্য কৃষি বিভাগের উদ্যোগে জেলায় জেলায় কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থা করতে হবে। ভিয়েতনামে ড্রাগন চাষে একধরণের প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়। যার মাধ্যমে বাগানের ফলের বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এতে দেখা যায়, এক বাগানের ফল যখন পাকতে শুরু করেছে, অন্য বাগানের গাছে তখন সবে মাত্র কুঁড়ি এসেছে। সে কারণে সব ফল একসাথে বাজারজাত করতে হয় না, বাজারেও অনেকদিন ফল পাওয়া যায়। ড্রাগন ফলের চাষের বৃদ্ধির সাথে সাথে এ ধরণের প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের এখানেও করা প্রয়োজন। এভাবে নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে চাষ করলে, চাষীও ক্ষতির হাত থেকে বাঁচবেন। এর জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।”’

সুশান্ত কুমার প্রামাণিক মনে করেন, কৃষকরা ফলের নায্যমূল্য পাচ্ছেন না। এ ফলকে রপ্তানীমুখী করতে পারলে ফল থেকে আয় বাড়তো, কৃষকরাও ভালো দাম পেতেন। আরও কৃষক ড্রাগন চাষে উদ্বুদ্ধ হতেন। রপ্তানির জন্য উন্নত কৃষিচর্চা, ফলের গুণগত মান, সংরক্ষণ ও পরিবহন ব্যবস্থাপনায় জোর দিতে হবে বলে তিনি মনে করেন।

“ফল সংরক্ষণের জন্য বিশেষায়িত কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থা করা গেলে অফ সিজনে ফল বিক্রি করা যাবে এবং দাম ভালো পাওয়া যাবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কৃষি বিভাগের প্রচেষ্টা আছে; জানান সুশান্ত কুমার প্রামাণিক ।

XS
SM
MD
LG