সরকারের পক্ষ থেকে নানা ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার পরও বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর ২০২১ সাল জুড়ে হামলা হয়েছে বলে তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে ২ জুন প্রকাশিত ২০২১ সালের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রতিবেদনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও জাতিগত সংখ্যালঘু সদস্যদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ কিংবা জমি দখল রোধে সরকার পদক্ষেপ নিলেও সুফল আসেনি। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ এবং মানবাধিকারকর্মীদের প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছে ভয়েস অফ আমেরিকা।
প্রতিবেদনে কী আছে
২০২১ সালের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক দুই হাজারের বেশি পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে ১৬ পৃষ্ঠার একটি পর্যালোচনা রয়েছে। শুরুতে বলা হয়েছে, সংবিধানে ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হলেও বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ সমুন্নত রেখেছে। সাংবিধানিকভাবে ধর্মীয় বৈষম্য নিষিদ্ধ এবং সব ধর্মের জন্য সমতার ব্যবস্থা আছে। আদালতে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর জন্য পৃথক পারিবারিক আইনের বিধান রয়েছে।
২০২১ সালের অক্টোবরের কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "অক্টোবরের ১৩ থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া হিন্দুবিরোধী সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় মুসলিম এবং হিন্দুসহ কয়েকজনের প্রাণহানি হয়। সরকার হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে। পাশাপাশি ২০ হাজারের বেশি মানুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।"
ধর্মীয় ইস্যুতে ৩টি ‘হাই-প্রোফাইল’ মামলার রায়ের কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "২০১৫ সালে একজন প্রকাশককে হত্যার দায়ে ৮ জঙ্গিকে ফাঁসি দেয়া হয়। একই বছর একজন নাস্তিক ব্লগারকে হত্যার দায়ে ৫ জনকে এবং ২০০০ সালে প্রধানমন্ত্রীকে হত্যাচেষ্টার ষড়যন্ত্রের দায়ে নিষিদ্ধ ইসলামি গোষ্ঠীর ১৪ সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।"
"জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ এবং উসকানিমূলক বার্তা দেওয়া বন্ধে মসজিদগুলোতে পর্যবেক্ষণ এবং সারা দেশের ইমামদের খুতবার বিষয়বস্তু সম্পর্কে নির্দেশিকা দিয়েছে সরকার।"
জমি দখলের বিষয়ে সংখ্যালঘুদের অভিযোগের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে জোরপূর্বক উচ্ছেদ এবং জমি দখল ঠেকানের ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতার কথা হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ ধারাবাহিকভাবে বলে গেছেন। ধর্মীয় স্থাপনা, উৎসব এবং যেসব এলাকা হামলার টার্গেট হতে পারে সেসব স্থানে সরকার নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করেছে।"
প্রতিবেদনে ১৩ অক্টোবর মন্দিরে পবিত্র কোরআন রেখে সহিংসতা সৃষ্টির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ওই ঘটনার পর দেশজুড়ে মন্দিরে এবং হিন্দুদের সম্পত্তির ওপর হামলা হয়েছে। এই সহিংসতা চলে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত। জাতীয় হিন্দু নেতারা ৪ নভেম্বরের দিওয়ালীতে আবার হামলার আশঙ্কায় সীমিত পরিসরে মন্দির এবং বাড়িতে পূজা উদযাপন করেন। হিন্দুদের নিরাপত্তাহীনতার অভিযোগে পূজারিরা মুখে কালো কাপড় বেঁধে প্রতিবাদ জানান।
প্রতিবেদনের ‘গভর্নমেন্ট প্রাকটিসেস’ অংশে বলা হয়েছে, "অক্টোবরে একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে হিন্দুদের ওপর যে হামলা চালানো হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তার প্রতিবাদ জানানো হয়। ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে হিন্দু পরিবারকে ভবন নির্মাণে অনুদান দেয়ার পাশাপাশি খাদ্য সামগ্রী সরবরাহ করা হয়।"
এই প্রতিবেদন মে মাসে মা দিবসে অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী তার মায়ের সঙ্গে একটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট করার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। সেই ছবিতে তার মায়ের কপালে সিঁদুর দেখা যাওয়ায় অভিনেতার উদ্দেশ্যে আপত্তিকর মন্তব্য করা হয়।
গণমাধ্যমের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "সেপ্টেম্বরে কুতুপালং ক্যাম্পে রোহিঙ্গা মুসলমানরা এক রোহিঙ্গা খ্রিস্টানের দাফনে অস্বীকৃতি জানায়।"
‘মানবাধিকার সংস্থাগুলো সাম্প্রদায়িক সহিংসতার তথ্য দিতে থাকে এবং হিন্দু অথবা মুসলিম থেকে খ্রিস্টান হওয়াদের সামাজিক বিচ্ছিন্নতার কথা জানায়। বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ জানিয়েছে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বছর জুড়েই ছিল। সরকারি কর্মকর্তা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, ধর্মীয় নেতা, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত, দূতাবাসের অন্য প্রতিনিধি এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থার একজন সিনিয়র কর্মকর্তা তাদের বৈঠকে ধর্মের নামে এসব সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা করে সহনশীলতার পরিবেশ গড়ে তুলতে তাগিদ দেন। এ বছর রাষ্ট্রদূত খ্রিষ্টান, মুসলিম, হিন্দু এবং বৌদ্ধদের উপাসনালয় পরিদর্শন করে ধর্মীয় বৈচিত্র্য এবং আন্তঃধর্ম সহনশীলতার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকার শক্তিশালী করার কথা জানান।’
প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০২১ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের (যাদের অধিকাংশ মুসলিম) জন্য ৩০২ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছে।
প্রতিবেদনের সেকশন চারে ‘গভর্নমেন্ট পলিসি অ্যান্ড এনগেজমেন্ট’ অংশে বলা হয়েছে, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহিষ্ণুতার গুরুত্ব বোঝাতে রাষ্ট্রদূত এবং দূতাবাসের অন্য প্রতিনিধিরা প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের কর্মকর্তা, ধর্ম মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকারি প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়মিত সাক্ষাৎ করেছেন।
প্রতিক্রিয়া
রানা দাশগুপ্ত
সাধারণ সম্পাদক, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ
সংখ্যালঘুরা ভালো নেই। তাদের অস্তিত্ব আজ হুমকির সম্মুখীন। সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ তৃণমূলে ছড়িয়ে গেছে। রাষ্ট্র, প্রশাসন, রাজনীতি এমনকি সমাজের সর্বস্তরে সাম্প্রদায়িকতা আজ বাসা বেঁধেছে। বাঙালি আর বাঙালি থাকছে না। এই বাস্তবতায় সংখ্যালঘুদের ওপর যে নির্যাতন চলছে, তা প্রতিরোধে না আছে প্রশাসন; না আছে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিরোধ। যখন মামলা হয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা ধরা পড়ে। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই তারা বেরিয়ে আসছে। তাদের কোনো বিচার হয় না।
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে সরকার অর্থাৎ এই দল যে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তাতে বলা হয় নির্বাচনে জয়ী হলে, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন, বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন করা হবে এবং অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন এবং পার্বত্য শান্তিচুক্তি দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে। এখন আরেকটি নির্বাচন হতে দুবছরের মতো বাকি। কিন্তু আজও এ ব্যাপারে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ সরকারি দলের দিক থেকে আমরা দেখলাম না।
যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রতিনিধি (রাশাদ হোসাইন) যেদিন ঢাকায় এলেন, সেদিন রাষ্ট্রদূতকে নিয়ে তিনি বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের কার্যালয়ে আসেন। ঘণ্টা খানেক ছিলেন। এখানে তিনি নামাজও পড়েন। আমরা তার কাছে বাংলাদেশের প্রকৃত বাস্তবতা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। তার বক্তব্য শুনে আমার মনে হয়েছে, তিনি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা, চীনের উইঘুর সংখ্যালঘু এবং বাংলাদেশের সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
আমরা পরিষ্কার করে তাকে বলেছি, যে লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা সফল হয়নি। বিশেষ ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম করায়, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের মূলনীতি ‘ঠুঁটো জগন্নাথে’ পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ কার্যত সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
আরমা দত্ত,
এমপি
আমি বিশেষভাবে বলতে চাই, সংখ্যালঘুদের বর্তমান সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থা আগের চেয়ে অনেক অনেক ভালো। আগের অবস্থা তুলনা করলেই এটা স্পষ্ট বোঝা যাবে। এখন প্রতি বছর অসাধারণভাবে বাংলাদেশে পূজাপার্বণ পালিত হয়। গতবারও প্রায় ৫০ হাজার দুর্গা পূজা হয়েছে। এখন কিছু যদি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে, এটা কিন্তু ধর্মীয় ব্যাপারের জন্য না। দুষ্ট প্রকৃতির লোক সব সময়ই থাকে। এটা মানতে হবে। সব এলাকায় জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ নিয়মিত ঘটনা। এসব দেখে আমরা বলতে পারবো না যে সংখ্যালঘুরা খারাপ আছে। সংখ্যালঘুরা ব্যবসাক্ষেত্রে এখন প্রচুর বিনিয়োগ করছে, লাভবান হচ্ছে। কোথাও অভিযোগ নেই।
আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রচুর অর্থ দিচ্ছেন। হিন্দু কল্যাণ ট্রাস্টে হাজার কোটি টাকা দিয়ে রেখেছেন। এগুলো দিচ্ছেন যেন আমরা শান্তিপূর্ণ সহবস্থানে থাকতে পারি। আমরা যেন অসাম্প্রদায়িক পরিবেশে, ভালোবাসার সঙ্গে, সাম্যের সঙ্গে বসবাস করতে পারি, তিনি সেই চেষ্টা করছেন।
যদি হামলা-নির্যাতনের প্রসঙ্গ আসে, তাহলে আমি বলব আমাদের বিচার ব্যবস্থাটাকেই উন্নত করতে হবে। যাতে সবাই তাড়াতাড়ি সুবিচার পান। এখন কথা হল, বিচার ব্যবস্থা শুধু সংখ্যালঘুদের জন্য নয়; এটা সংখ্যাগুরুদের জন্যও। কোর্টে গেলে দেখা যাবে হাজার হাজার ফাইল পড়ে আছে। বিষয়টা তাই সবার জন্য ভাবতে হবে।
চঞ্চল চৌধুরী
অভিনেতা
আমি যখন মায়ের সঙ্গে ছবি পোস্ট করি, মা সিঁদুর পরা ছিলেন, অনেকেই বাজে মন্তব্য করেন। কিন্তু আমি বলব ৯২ শতাংশ মানুষ তখন প্রতিবাদ করেন। সহকর্মীদের অনেকেই আমার পাশে ছিলেন। ছিলেন তারাই, যারা মানুষ পরিচয়টাকে বড় করে দেখেন। এই পাওয়াটাই বড় ছিল।
আমি একজন শিল্পী। শিল্পীর তো জাতপাত নেই। শিল্পী সব ধর্মের। সব জাতির। কিছু মানুষ হয়তো তখন বাজে মন্তব্য করেছে। ওই মন্তব্য থেকেই তাদের পারিবারিক শিক্ষাটা বোঝা যায়।
আমাদের জন্ম যেকোনো ধর্মেই হতে পারে। এখানে কারো হাত নেই। কিন্তু পৃথিবীতে আসার পর সবচেয়ে বড় পরিচয় হওয়া উচিত মানুষ। ধর্ম যার যার। মানুষ পরিচয়কে ধারণ করতে প্রথমে দরকার পারিবারিক শিক্ষা। পরিবার থেকে একজন বাবা-মা তার সন্তানকে কোনো ধর্মের পরিচয়ে পরিচিত করবেন, না কি মানুষ হিসেবে পরিচিত করবেন-এটা যদি বাবা-মা ছোটবেলা থেকে মাথায় রাখেন সঙ্গে সামাজিকভাবে চর্চাটা হয় এবং শিক্ষকেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এগুলো বোঝায় তাহলে সম্ভব।
ভূপেন হাজারিকার ‘মানুষ, মানুষের জন্য’ গানটা এ কারণেই আমার প্রিয়। একজন জন্মের পর যখন তার ধর্মের পরিচয় থেকে মানুষ পরিচয়কে বড় করে তুলতে পারে, তখনই তার সার্থকতা। ধর্মীয় পরিচয় খারাপ কিছু আমি সেটা বলছি না। নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার সবার আছে। কিন্তু তার মানে কট্টর হয়ে অন্য ধর্মকে হিংসা করা-এটার আমি একদম বিপক্ষে।
আমি চারুকলায় পড়েছি। নিজেকে সেভাবেই সহিষ্ণু হিসেবে তৈরি করেছি। আমার বাড়িতেও তাই। মা অন্য ধর্মের বন্ধুদের নিজ হাতে খাওয়াতেন। এই মানুষ হওয়ার প্রক্রিয়াটা এখন কমে গেছে।
সাম্প্রদায়িক মনোভাব পোষণ করা মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে কম, কিন্তু তারা অনেক সংগঠিত। তাই তাদের আস্ফালনটা বেশি দেখা যায়। যারা সহনশীল মানুষ, তারা নিজেদের নোংরামির ভেতর নিতে চান না। চুপ থাকেন। বাংলাদেশে কিন্তু প্রচুর অসাম্প্রদায়িক মানুষ আছেন। তখন তারা আমার পাশে ছিলেন।
তবে ২০ বছর আগের বাংলাদেশ আর এখনকার বাংলাদেশের কথা যদি বলি, তাহলে বলব এখন অসহিষ্ণুতা বেড়েছে। নিজেদের বড় করে দেখার যে প্রবণতা, সেটা বেড়েছে। এটা সব ধর্মেই আছে।
বিপ্লব বড়ুয়া
দপ্তর সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। তখন মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম দর্শন ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রণয়ন করা। জাতির পিতা যখন সংবিধান প্রণয়ন করেন, তখন এই ধর্মনিরপেক্ষতা স্থান পায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সূচনা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা নিজেদের অবৈধ ক্ষমতাকে বৈধতা দেয়ার জন্য দেশে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করে। পরবর্তীতে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল পুনরায় চালু হয় এবং যুদ্ধাপরাধীরা বাংলাদেশে ফিরে আসে। আজকে জননেত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করার পর বাংলাদেশের সংবিধানকে একটি অসাম্প্রদায়িক সংবিধানে পরিণত করেছেন। আজকে জীবন-জীবিকার প্রতিটি স্তরে সব ধর্মের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। সরকারি নিয়োগে, পদোন্নতিতে সব ধর্মের মানুষ নিজেদের মেধা বিকাশে যথাযথ সুযোগ পাচ্ছেন। মানুষের ধর্মের অধিকার যেন ক্ষুণ্ণ না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে কাজ করছে ধর্ম মন্ত্রণালয়।
আজকে স্বাধীনতার বয়স ৫০ বছর। এর মধ্যে প্রায় ৩০ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল সাম্প্রদায়িক, 'ধর্মান্ধ গোষ্ঠী' বিএনপি-জামায়াত। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মান্ধ গোষ্ঠীরা রাষ্ট্রীয় জীবনে, সমাজ জীবনে গভীরভাবে নিজেদের সংহত করেছিল। আজকে যে সব জায়গায় সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হচ্ছে, আক্রমণকারী কিন্তু ওই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। সরকার তাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছে। যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। হামলাকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
বলা হচ্ছে বিচারগুলো দীর্ঘায়িত হচ্ছে। কিন্তু সরকার তো অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করে। আমি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ, নিজের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি ২০১২ সালে কক্সবাজারে রামুর বৌদ্ধ পল্লীতে যে ঘটনা ঘটেছিল, সেখানে একাধিক মামলা হলেও যথাযথ সাক্ষীর অভাবে মামলাগুলোর অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। আমি মনে করি, যারা ভিকটিম তাদেরও সাহসী হয়ে বলিষ্ঠভাবে সরকারকে সহযোগিতা করা উচিত। আমি আগেও বলেছি সাম্প্রদায়িকতা বাংলাদেশ থেকে নির্মূল করার জন্য একটি রাজনৈতিক ঐক্য দরকার। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এই জায়গায় জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছে।
নিপুণ রায় চৌধুরী
বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়ে ধারণা পাওয়া যাবে। দীর্ঘ ১৩-১৪ বছর বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পন্থার কোনো চর্চা নেই। যে দেশ গণতান্ত্রিক পন্থায় পরিচালিত হয় না, সেখানে নানা ধরনের সহিংসতা, বিচারহীনতা, নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করে। ন্যায় বিচার বলে কিছু থাকে না। ঠিক এমন একটি পরিস্থিতিতে আমরা বাংলাদেশে রাজনীতি করছি। একজন নাগরিক হিসেবে দিন যাপন করছি।
দেশে ঘুম, খুন, ধর্ষণের কোনো বিচার হচ্ছে না। বিশ্বজিৎ হত্যার সঠিক বিচার কি হয়েছে? যারা দোষী তারা কি সর্বোচ্চ শাস্তি পেয়েছে? পায়নি। বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার রায়ের পর তার বা-মা কান্না করে বলেছে, সন্তান হত্যার সঠিক বিচার তারা পাননি।
শাল্লাতে ঘটনা (সাম্প্রদায়িক সহিংসতা) ঘটেছে, রামুতে ঘটনা ঘটেছে, খুলনায় ঘটেছে। একটা ফেসবুকের স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে এসব ঘটেছে। শাল্লাতে আমি নিজে গিয়েছি। সেখানে মাইকে ঘোষণা দিয়ে হিন্দু পল্লীতে আক্রমণ চালানো হয়। হামলা হয় ওই ওয়ার্ডের যুবলীগের সভাপতির নেতৃত্বে। সেখানে ওসি আছে, ইউএনও আছে, জেলা প্রশাসক আছে। তারা কিন্তু সবকিছুই জানেন। আগের দিন রাতে মাইকে ঘোষণা দিয়ে, পরের দিন আক্রমণটা হয়। প্রশাসনের এই যে নীরবতা তাতে তো বোঝাই যায় সরকারের এখানে হাত আছে।
এখন সরকার কথায় কথায় সব কিছুতে বিএনপিকে দায়ী করে। বিএনপি তো দীর্ঘ ১৪ বছর ক্ষমতায়ই নাই। বিএনপি তো অস্ত্র নিয়ে মাঠে নামে না।
আমাদের আমলে যে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হয়নি, সে কথা বলছি না। বিএনপির সময়েও নির্যাতন হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে সংখ্যালঘু নির্যাতনের মাত্রা যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, সেটি শঙ্কার। বিএনপির আমলে কিছু না কিছু বিচার হতো, আওয়ামী লীগ বিচারের প্রক্রিয়াই নষ্ট করে দিয়েছে। ভয়ভীতি দেখানোর কারণে অনেক পরিবার ভারতে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
আমার কথা হলো এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে হলে স্বাধীন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সবার আগে প্রয়োজন। একদিনের ভোট দেয়াই গণতান্ত্রিক চর্চা না। একদিনের ভোটে জনগণ সরকার গঠন করবে। সেই সরকার হবে জনগণের সরকার। জনগণের কাছে তার জবাবদিহিতা থাকতে হবে। জবাবদিহিতার জায়গা স্পষ্ট থাকলে, সরকার অনেক কিছু চাইলেও করতে পারে না।