কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে, বাংলাদেশের সিলেট নগরী এবং জেলার ১৩ উপজেলার গ্রাম থেকে গ্রামান্তর নদীর পানিতে একাকার। বৃহস্পতিবার (১৯ মে) সকাল পর্যন্ত সিলেট নগরীতে আরও দুই ইঞ্চি পানি বেড়েছে।
এছাড়াও উপজেলাগুলোতেও বন্যার পানি বেড়েছে। এ অবস্থায় সিলেট জেলা ও মহানগরের অন্তত ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এসব মানুষ বিশুদ্ধ পানি, খাবার, বিদ্যুৎ ও নানামুখী সংকটে দুর্বিষহ সময় কাটাচ্ছেন। এছাড়া গবাদিপশু নিয়েও বিপাকে পড়েছেন মানুষ।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে,“সিলেটের প্রধান নদী সুরমা কানাইঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ১২৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আর সিলেট পয়েন্টে ১৩ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৪২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।”
এছাড়া, কুশিয়ারা নদীর পানি অমলসিদ (সিলেট) পয়েন্টে ২০ সেন্টিমিটার বেড়ে এখন বিপদসীমার ১৫৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপরদিকে শেওলা (সিলেট) পয়েন্টে নদীটির পানি বেড়েছে ৮ সেন্টিমিটার, এখন তা বিপদসীমার ৫৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে যাচ্ছে; বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাসে আরও বলা হয়েছে, ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট ও সুনামগঞ্জের নিম্নাঞ্চলের কিছু স্থানে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হতে পারে।
বুধবার (১৮ মে) বিকালে, নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সিলেট ফায়ার সার্ভিস অফিস, সিলেট বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, উপমহাপুলিশ পরিদর্শকের কার্যালয়, কোতোয়ালি থানা, বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয়, তোপখানা সড়ক ও জনপথের কার্যালয়, সোবহানীঘাট পুলিশ ফাঁড়ি, বিদ্যুতের আঞ্চলিক কার্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকেছে। নগরীর বন্যাকবলিত এলাকা ছাড়া, উপজেলাগুলোর বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও জলমগ্ন হয়ে পড়েছে।
প্রশাসন ও জনপ্রতিরা জানিয়েছেন, সিলেট নগরের অন্তত ৩০টি এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
উপজেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্লাবিত হয়েছে কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জকিগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও সিলেট সদর উপজেলা। জেলার ১৩টি উপজেলার হাজারো গ্রাম এখন প্লাবিত।
সিলেট নগরের তপোবন, সুরমা ও লেকসিটি এলাকার কয়েকশ’ পরিবার এখন ঘরবন্দী জীবন কাটাচ্ছে।
স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, “এই তিন এলাকার পাশে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান। ফলে এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী বসবাস করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। ফলে পানিতে ভিজে হেঁটে হেঁটেই তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত করছেন। অনেকে দুর্ঘটনায়ও পড়ছেন।”
একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তপোবন, সুরমা ও লেকসিটি এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে শিক্ষার্থীরা মেস করে থাকেন। কয়েকশ’ শিক্ষার্থী এসব এলাকার মেসে থাকছেন। বন্যার পানি ক্রমাগত বেড়ে চলায়, কয়েক দিন ধরে মেসে নিয়মিত গৃহকর্মী আসছেন না। ফলে খাবারের সমস্যায় পড়েছেন তারা।
এদিকে, সিলেট নগরের বন্যাক্রান্ত আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছেন অনেক মানুষ।
সিলেট নগরীর, কিশোরী মোহন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন ষাটোর্ধ্ব রেজিয়া বেগম। একই আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন তাঁর ছেলে কবির হোসেন (৩৫) ও নাতি ফারহান হোসেন। বন্যা পরিস্থিতি তুলে ধরে রেজিয়া বলেন, “একটু একটু করি পানি বাড়ছিল। মঙ্গলবার সকালে আর ঘরে থাকা যায়নি। কাঁথা-কম্বল নিয়া বাইরে আইতে ওইছে। আশ্রয় নিছি স্কুলে। ইখানে গত মঙ্গলবার রাইত চিড়া আর গুড় দিছে। হুকনা খাওয়ার (শুকনা খাবার) গলা দিয়া নামে না। চিড়া ভিজাইয়া গুড় দিয়া মাখিয়া খাইছি।”
রেজিয়ারা থাকেন নগরের যতরপুর এলাকার নুরুল হকের কলোনিতে। সোমবার রাত থেকে পানি বাড়তে থাকে। মঙ্গলবার সকালে বুক অবধি পানি পৌঁছায়। তিনি বলেন, “ঘরের আসবাবসহ সবকিছু খাটের উপর তুলে রেখে এসেছি। ছেলে কবির হোসেন সকালে ঘরে গেছে অবস্থা দেখতে। আশ্রয়কেন্দ্রে তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছে না। খাওয়ার পানির জন্য সিটি করপোরেশনের একটি গাড়ি রয়েছে স্কুলের সামনে। এ ছাড়া স্কুলের শৌচাগার রয়েছে। বিদ্যুৎ-ফ্যান সবই রয়েছে। তবে খাওয়ার সমস্যা আছে। আশ্রয়কেন্দ্রে শুকনা খাবার দিলেও রান্না করার কোনো ব্যবস্থা কিংবা রান্না করা খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা নেই। এছাড়া বৃষ্টিতে ভিজে শরীরে জ্বর এসেছে। ওষুধের ব্যবস্থা করলে ভালো হতো।”
এদিকে, সিলেট আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী জানিয়েছেন, “আগামী কয়েক দিন বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে। তাছাড়াও ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বৃষ্টিও কমছে না। তাই পাহাড়ি ঢল নামায় পানি বাড়ছে।”
অপরদিকে, সিলেট জেলার, জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, সিলেট সদর, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার উপজেলায় বাড়ছে পানি। এসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেমন ত্রাণ তৎপরতা কম, তেমনি নেই উদ্ধার তৎপরতাও। এছাড়া রয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্যের সংকট।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. আনোয়ার সাদাত বুধবার বলেন, “জেলায় ২৭৪টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ৭৮টি ব্যবহার হচ্ছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন ৬ হাজার ৪৭৫ জন। ২২০টি গবাদিপশুও আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই পেয়েছে।”
বন্যার কারণে, সিলেট নগরসহ বিভিন্ন উপজেলার বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির প্রায় সাড়ে ১১ লাখ গ্রাহকের মধ্যে দেড় লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে।
বন্যা পরিস্থিতিতে, সিলেট বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের দুটি উপকেন্দ্র ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির দুটি উপকেন্দ্রে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে, চারটি উপকেন্দ্রের গ্রাহকদের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে।