সাক্ষাৎকারঃ সুবর্ণা মুস্তাফা
সুবর্ণা মুস্তাফা বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান অভিনয়শিল্পী। বাংলাদেশের মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে তিনি তার অভিনয় মুগ্ধতা ছড়িয়ে চলেছেন কয়েক যুগ ধরে। অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা অর্জন করেছেন। পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় সম্মাননা- একুশে পদক। ২০১৯ সাল থেকে জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশে এক নারী শিক্ষক ‘টিপ’ পরার কারণে এক পুলিশ সদস্যের দ্বারা হেনস্থার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এই ঘটনায় ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা হয়েছে। জাতীয় সংসদে, পয়েন্ট অব অর্ডারে রাখা বক্তব্যে, সুবর্ণা মুস্তাফা এই ঘটনার তীব্র সমালোচনা করেন এবং বিচার দাবি করেন। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এই বিষয় ছাড়াও, প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ে এই অভিনেত্রী ও সংসদ সদস্য কথা বলেছেন ভয়েস অফ অমেরিকার সঙ্গে। ভয়েস অফ আমেরিকার পক্ষে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন এহসান মাহমুদ।
ভয়েস অফ আমেরিকা: টিপ সংশ্লিষ্ট সাম্প্রতিক ঘটনাটি দেশে খুবই সমালোচিত হলো। ওই ঘটনার শুরুতেই জাতীয় সংসদে আপনার বক্তব্য অনেক আশা জাগিয়েছে। প্রশংসিত হয়েছে এই বক্তব্য। আমরা জানতে চাইছি, সংসদে আপনি ছাড়া আরও অনেক সংসদ সদস্য ছিলেন। বিশেষ করে, নারী সংসদ সদস্যদের তুলনায় পুরুষের সংখ্যা বেশি। সেখানে একজন নারীকেই কেন এই ঘটনার প্রতিবাদ করতে হলো?
সুবর্ণা মুস্তাফা : প্রথমেই যদি দেখি যে, আমি সেদিন সংসদের পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে কি বলেছিলাম। আমি কিন্তু এমন কিছু বলিনি যা নতুন। সেদিনের সংবাদপত্রে, টেলিভিশনে এই বিষয়ে খবর ছাপা হয়েছে, প্রকাশিত হয়েছে। সেই কথাটিই আমি বলেছি। সেদিন বেশকিছু বিল উত্থাপিত হচ্ছিল, পাস হচ্ছিল। তারই মাঝে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে কিছু বলেছিলাম। এখন আমি বিশ্বাস করি না যে, আমি নারী বলেই একজন নারীর হেনস্থা হওয়ার বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি।
ভয়েস অফ আমেরিকা: আপনি যেহেতু ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের একজন মনোনীত সংসদ সদস্য, তাই এই প্রশ্নটি আপনাকে করতে চাই। সংসদে এই ধরনের স্পর্শকাতর ইস্যুতে কোনো আলোচনা হয় না; ধর্মকে ও প্রচলিত নানা নিয়মকে মানুষের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে; এমন পরিস্থিতিতে, এইভাবে সংসদে দাঁড়িয়ে এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলার অনুপ্রেরণা বা সাহস কোথায় পেলেন যদি আমাদের জানান।
সুবর্ণা মুস্তাফা : এটা তো সাহসের বিষয় না। সত্য কথা বলতে তো সাহস লাগে না। চুরি করতে সাহস লাগে। একটা কথা প্রচলিত আছে যে, একটা মিথ্যা একশ বার বললে তা সত্য হয়ে যায়। এটা যে কতো বাজে একটা কথা! তাই, আমি যেটা বিশ্বাস করেছি, যেটা সত্য সেটাই বলেছি।
আরেকভাবে যদি বলতে চাই, কোথা থেকে এই কথা বলার সাহস পেলাম- তাহলে বলবো আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পেয়েছি। কারণ, তাকে এইরকম বিষয়গুলো বা এই সমস্যাগুলো আরও ব্যাপক পরিসরে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। তাই, তাকে দেখেই এই সাহস পেয়েছি বলে মনে হয়। এছাড়া আমাদের বঙ্গবন্ধু তো সব সময় মানুষের কথাই বলেছেন। তাই, মানুষের জন্য কথা বলার একটা সাহস আমরা সবসময়ই পাই বলে মনে করি। আমাদের দেশের স্বাধীনতার পরেও, নব্বইয়ের গণ আন্দোলন কিংবা আরও পরে, গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনসহ অন্যান্য প্রগতিশীল আন্দোলন বা নানা সংগ্রামে যাদেরকে আমরা নেতৃত্ব দিতে দেখেছি, তারাও কোনো না কোনো ভাবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের মানুষ। বঙ্গবন্ধুকে যারা অনুসরণ করেন, তারা সবাই, মনে করি, মানুষের জন্যই কাজ করেন। তিনি সরকারে বা আমাদের মতো যে কোনো পর্যায়েই থাকুন না কেন। এসব কাজে বঙ্গবন্ধুই আসল সাহস বা অনুপ্রেরণা বলে মনে করি।
আমরা মনে করতে পারি, পঁচাত্তর পরবর্তি সময়ে প্রায় ২০/২১ বছর দেশ অন্ধকারে ছিল। মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা, দেশ সেখান থেকে দেশ সরে গিয়েছিল। সেই কঠিন সময়ে যারা বেড়ে ওঠেছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বা চেতনা নিয়ে, তারা কিন্তু এখন ক্ষমতায় বা উচ্চ পর্যায়ে রয়েছেন। একটা পরিবর্তন এখন হচ্ছে। উন্নয়ন হচ্ছে। আবার এটা নিয়ে নানা কথাও হচ্ছে। যেমন, কেউ হয়তো বলতে পারেন বাংলাদেশের মানুষ সকালে ওঠে উন্নয়ন গুলিয়ে এক কাপ কফি বানিয়ে খাবে? ঢাকায় ট্রাফিক জ্যাম কিছুটা বেড়েছে। হ্যাঁ, এসব বেড়েছে সত্যি। আবার, কেউ বলতে পারেন এখন দ্রব্যমূল্য কিছুটা বেড়েছে। রমজান মাসে এখানকার দ্রব্যের দাম বেড়েছে। বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় ব্যবসায়ীরা যে কোনো উৎসবে দাম কমিয়ে দেয়, আর এইদেশে দাম বাড়ে। এইসব অন্ধকার দিকতো আছে। তারপরেও, একটি লড়াইয়ের মধ্যদিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। এখন মেট্টোরেল হচ্ছে, পদ্মাসেতু হচ্ছে, এসবের সুবিধা তো একদিন দেশটা পাবে। অবশ্যই পাবে। হয়তো ২০৪০/৪১ পর্যন্ত আমি থাকবো না। দেশটা থাকবে। তখন এসবের সুফল দেশ অবশ্যই ভোগ করবে।
আমাদের দেশে যে ধর্মান্ধতার কোনো জায়গা নেই, সংবিধানে কোনো জায়গা নেই এটা তো বঙ্গবন্ধুই নিশ্চিত করে গিয়েছেন। তাই এসবকে জায়গা দেওয়া যাবে না। প্রয়াত লেখক হুমায়ূন আহমেদ একটা কথা বলেছিলেন- "রাজাকারের ঘরে সব সময় রাজাকারই হয়।" আজকাল এই কথা বলা খুব কঠিন যে, একজন প্রগতিশীলের ঘরে একজন মুক্তমনা প্রগতিশীলই জন্ম নেবে। যেভাবে ‘ব্রেনওয়াশ’ করে বিপথগামী করা হয়, তা খুবই ভয়ঙ্কর ও হতাশাজনক। জঙ্গিবাদসহ নানা দিকে নিয়ে নেওয়া হচ্ছে সমাজকে।
ভয়েস অফ আমেরিকা: বাংলাদেশে এখন যে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে, সেখানকার সাথে আগের সময়ের কোনো পার্থক্য আপনার চোখে পড়ছে কিনা? বিশেষকরে, নারী স্বাধীনতা বা নারীর মত প্রকাশের মতো বিষয়ে?
সুবর্ণা মুস্তাফা : নারীর ক্ষমতায়নের কথা যদি বলতে চাই, অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। আমি তো দেখেছি, জাতীয় দিবসে, সেনাবাহিনীর প্যারেডে সামনের সারিতে থাকছেন নারী, দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, স্পিকার নারী, বিরোধী রাজনৈতিক দলেও নারী। এছাড়া এদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি পোশাকশিল্প, সেখানেও নারীরাই এগিয়ে। আর, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, কূটনীতিক- সকল ক্ষেত্রেই নারীর অংশগ্রহণ রয়েছে। চলতি বছরের (২০২২) নারী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়ের দিকে যদি আমরা দেখি, তবে দেখতে পাব, নারী পুরুষের সমতার কথাই বলা হয়েছে। অর্থাৎ, টেকসই আগামীর জন্য নারী-পুরুষের সমতা জরুরি। এখন সেটাই আগে করতে হবে। জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশকে বাদ দিয়ে তো এগিয়ে যাওয়া যাবে না। তাই উন্নয়ন এবং এগিয়ে যাওয়ার জন্যও নারী-পুরুষের সমতার নিশ্চিত করতে হবে।
ভয়েস অফ আমেরিকা: একজন নারী সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্বপালনের আগে আপনি বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান অভিনয়শিল্পীও। আপনাকে আমরা সেভাবেই জেনে এসেছি। দুটো ভিন্ন ক্ষেত্রে আপনি কাজ করছেন। এখন একজন সংসদ সদস্য হিসেবে আপনার কী মনে হয়, দেশে নারীর ক্ষমতায়নে বা নারীর সম-অধিকারের প্রশ্নে, বাংলাদেশের অবস্থান কেমন? সামগ্রিকভাবে এই দেশ নারী বান্ধব কিনা?
সুবর্ণা মুস্তাফা : আমি খুবই সৌভাগ্যবান। বাংলাদেশের মিডিয়া বা সংস্কৃতির যে ক্ষেত্রগুলো আছে, সেখানে, নারীদের জন্য, আমি বলবো, খুবই ভালো পরিবেশ। নারী হিসেবে আলাদা কোনো অযোগ্যতা আমার চোখে পড়েনি। আবার এখন যে সংসদে রয়েছি, সেখানেও নারী হিসেবে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি দেখছি না। অর্থাৎ, আমার মনে হয় এখন নারী হিসেবে কেউ চাইলে তার কাজটি করতে পারেন। নারী বলেই তাকে আর আটকে দেওয়া হয় না। নারীদের জন্য আমি দেখতে পাচ্ছি সমান ব্যবস্থাই রয়েছে।
ভয়েস অফ আমেরিকা: আমরা সবাই পরিবারেই বেড়ে উঠি। পরিবারকে বলা হয় রাষ্ট্রের প্রথম ধাপ। একটি শিশু তার নিজের পরিবারেই প্রথম ধারণা পায় নারী-পুরুষের। আপনার পরিবারে এমন কখনো হয়েছে কিনা, যে মেয়ে সন্তান না হয়ে, ছেলে সন্তান হলে আরেকটু ভালো হতো; বা এমন কিছু? এমন কোনো অভিজ্ঞতা রয়েছে কিনা?
সুবর্ণা মুস্তাফা : একদমই না। আমি বলবো যে, আমার পরিবার বাংলাদেশের ‘মোস্ট লার্নেড ফ্যামিলি’। আমার বাবা গোলাম মুস্তাফা। মা হোসনে আরা মুস্তাফা। আমার মা সেই সময়ে মঞ্চে নাটক করেছেন, যখন পুরুষেরা নারী সেজে মঞ্চে কাজ করতেন। আমাদের পরিবারে আমরা কখনো দেখিনি যে, বাবা এমন কোনো কথা বলছেন যাতে মা কষ্ট পেতেন। বরং বাবার কাছে আমরা কিছু চাইলে বাবা বলতেন, “দেখো, তোমার মা কী বলেন।” আমাদের পরিবারের সব সিদ্ধান্ত মা-ই নিতেন। পরিবারে নারী-পুরুষ আলাদা করার কোনো বিষয় আমরা শৈশবে দেখিনি।
ভয়েস অফ আমেরিকা: নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে সাহায্য করতে পারে এমন কোনো পরামর্শ রয়েছে কিনা আপনার?
সুবর্ণা মুস্তাফা : আমি মনে করি, এখানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা যারা রাখতে পারেন, তারা হলেন পুরুষেরা। সমাজের অর্ধেক অংশ পুরুষ, আরেক ভাগ নারী। তাই নারীর প্রতি সহিংসতা যা ঘটে, তা পুরুষের দ্বারা ঘটে। একারণে, নারীর প্রতি সহমর্মী হয়ে পুরুষকে এগিয়ে আসতে হবে। জগতের কোনো কিছুই পুরুষ একা করেনি। আবার, নারীর দ্বারাও একা সবকিছু করা সম্ভব নয়। কাজী নজরুলের কবিতাটি আমরা এখানে স্মরণ করতে পারি- “বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর / অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর”। নারী পুরুষের সমতা নিয়ে এটা আমারও বক্তব্য। তাই নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হলে পুরুষদেরই এগিয়ে আসতে হবে।