৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। ১৯৪৮ সালের এ দিনটিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)। তারপর ১৯৫০ সালের ৭ এপ্রিল থেকে প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে আন্তর্জাতিক ও স্থানীয়ভাবে দিনটি বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এবারে দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় ‘Our planet, our health’ ভাষান্তরে ‘সুরক্ষিত বিশ্ব, নিশ্চিত স্বাস্থ্য।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা WHO-এর লক্ষ্য করোনা মহামারি পরবর্তী সময়ে এমন এক বিশ্বের পরিকল্পনা করা যেখানে সবার জন্য বিশুদ্ধ বাতাস, বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের ব্যবস্থা থাকবে। সুস্বাস্থ্য ও ভালো থাকার লক্ষ্যে ঘুরবে অর্থনীতির চাকা। শহরগুলো হবে বাসযোগ্য। এবারের বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে WHO সারা বিশ্বের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এবং বিশ্বকে দুষণ থেকে রক্ষা করতে বিশ্বব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলার ওপর জোর দিচ্ছে। জলবায়ু সংকট এখন বিশ্বের বৃহত্তম পরিবেশগত স্বাস্থ্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত। WHO-এর তথ্য অনুযায়ী, পরিবেশগত কারণে প্রতি বছর ১ কোটি ৩ লাখেরও বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ অস্বাস্থ্যকর বাতাসে শ্বাস নিচ্ছে।
বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের তালিকায়, শীর্ষস্থানে আছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘আইকিউএয়ার’ প্রকাশিত ‘বিশ্বের বায়ুর মান প্রতিবেদন-২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয় বিশ্বের ১১৭টি দেশ ও অঞ্চলের ৬ হাজার ৪৭৫টি শহরের বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ করে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজধানী শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকার দ্বিতীয় স্থানে আছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। দীর্ঘদিন ধরেই ঢাকা বায়ুদূষণে ভুগছে। ঢাকার এ বায়ুদূষণের প্রভাব পড়ছে সরাসরি স্বাস্থ্যের উপর। বিশেষ করে শিশু ও প্রজনন স্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংক ২০১৯ সালের মার্চ মাসে একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, ঢাকার বায়ুদূষণের তিনটি প্রধান উৎস- ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণ কাজের ধুলো।
শিশুস্বাস্থ্যে ঢাকার বায়ুদূষণের প্রভাব
মেডিসিন ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. কে এম মুজাহিদুল ইসলাম ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “বাতাসে সালফার ডাই অক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড এবং অন্যান্য বিষাক্ত গ্যাসগুলো বেড়ে যাওয়ায় বায়ু দুষণ বাড়ছে। এর সাথে যোগ হয়েছে প্লাস্টিক কণা, যা মারাত্মক ক্ষতি করছে। বায়ুদূষণে ঢাকা শহর এখন দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। ঢাকার বায়ুতে ক্ষতিকর বস্তুকণার মধ্যে সীসাও আছে। এ সমস্ত উপাদান মানবদেহের ফুসফুসের মারাত্মক ক্ষতি করে। মানুষ নিঃশ্বাসের সঙ্গে এই বিষাক্ত উপাদানগুলো গ্রহণ করছে এবং শ্বাসতন্ত্রের নানা অসুখে ভুগছে। এমনকি হৃদরোগও বেড়েছে।”
তিনি বলেন, “বায়ুদূষণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে শিশুরা, বিশেষ করে যাদের বয়স ১৪ বছরের মধ্যে। শিশুদের ফুসফুসের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে ঢাকার বাতাসের মধ্যে থাকা ক্ষতিকর উপাদানগুলো। কারণ দূষণের ধাক্কা সামলানোর জন্য শিশুদের ফুসফুস পরিপক্ক থাকে না। আমাদের ফুসফুসের মধ্যে একটা তরল পদার্থ রয়েছে যাকে সারফেকট্যান্ট বলে। এটি ফুসফুসের দুটি অংশকে একসাথে আটকে যেতে বা সংকুচিত হয়ে যেতে বাধা প্রদান করে। সারফেকট্যান্ট না থাকলে আমাদের শ্বাস নিতে কষ্ট হবে। ঢাকার দূষিত বায়ু ফুসফুসের এই তরল পদার্থটি নষ্ট করে ফেলছে। বিশেষ করে, যানবাহনের পেট্রোল থেকে উৎপাদিত মাত্রাতিরিক্ত ধোঁয়া, ঢাকায় এই বিষাক্ত উপাদানগুলো ছড়াচ্ছে। এভাবে শিশু ও বয়স্ক মানুষের ফুসফুস কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। বড় ধরনের দীর্ঘদিনের শারীরিক সমস্যা যেমন সিওপিডি, শ্বসকষ্ট, হাপানি, ফুসফুসের প্রদাহজনিত সমস্যা বাড়তে পারে এমনকি ক্যানসারও হতে পারে।”
ডা. কে এম মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, “একটি শিশু যদি শৈশবেই এ ধরণের শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়, তাহলে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে এ সমস্যাগুলো জটিল আকার ধারণ করে। শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং তা অন্যান্য শারিরীক সমস্যাও তৈরি করে। সীসা শিশুদের হার্ট, কিডনি ও লিভারকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। শরীরের অপরিহার্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো আক্রান্ত হলে শিশুর আয়ুষ্কাল কমে যাবে। বায়ুদুষণের প্রভাব পড়ে খাদ্য, পরিবেশ, পানি সবকিছুর উপর। যার ফলে ঢাকায় জন্ম নেয়া নবজাতক শিশুর মধ্যে এখন হৃদরোগ, ডায়েবেটিসের মতো অসুখও পরিলক্ষিত হচ্ছে।”
প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব
ডা. কে এম মুজাহিদুল ইসলাম বললেন, “সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে প্রজনন স্বাস্থ্য। বায়ুতে উপস্থিত বিষাক্ত উপাদানের ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে মানুষের প্রজনন স্বাস্থ্যের উপর। এতে পুরুষের শুক্রাণু তৈরির পরিমান কমে যাচ্ছে, আবার ডিম্বানুর সাথে নিষিক্ত হওয়ার ক্ষমতা রাখে এমন সুস্থ্ শুক্রাণুও তৈরি হচ্ছে না। অপরদিকে নারীদের ক্ষেত্রেও তাই। ডিম্বাণু তৈরির পরিমান কমে যাচ্ছে। আবার দুর্বল বা নষ্ট ডিম্বাণু তৈরি হচ্ছে, ফলে এসব ডিম্বাণু যখন শুক্রাণুর সাথে নিষিক্ত হয়ে ভ্রূণ তৈরি করে সেই ভ্রূণ জরায়ুর নির্দিষ্ট জায়গায় অবস্থান তৈরি করতে পারে না। ফলে গর্ভপাত হয়ে যায়। আবার দেখা যাচ্ছে, কিছু প্রেগন্যান্সিতে গর্ভাবস্থায় শিশু বাড়ছে না। সেটারও মূল কারণ বায়ুদূষণ। এ ধরণের শিশু হয় গর্ভেই মারা যায় অথবা অতিরিক্ত অপুষ্টি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এ ধরণের দুর্বল শিশু জন্মের পরও বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারেনা। এজন্য বাংলাদেশে নবজাতক মৃত্যুর হারও দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে। যদিও সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কাজ হচ্ছে, দায়বদ্ধতা আমাদের সবার। একটা অসুস্থ ও বিকলাঙ্গ প্রজন্মের জন্ম হলে তা প্রজন্মান্তরে প্রটেনে যেতে হবে।”
যানবাহনের দূষণ এবং ঢাকার আশে পাশের এলাকাগুলো থেকে ইটভাটা সরানো গেলে বায়ুদূষণ কমানো সম্ভব হবে বলে মত দেন ডা. কে এম মুজাহিদুল ইসলাম।