প্রাচীন রোমের বিখ্যাত কুটনীতিক, রাজনৈতিক তত্ত্ব বিশারদ, আইনজ্ঞ ও দার্শনিক মার্কাস টুলিয়াস সিসারো বলেছেন, “A room without book is like a body without a soul.” অর্থাৎ “বই ছাড়া একটি কক্ষ আত্মা ছাড়া দেহের মতো।” ঘরের কোণে একটা বুকশেলফ, তাতে কিছু পছন্দের বই অথবা পুরো একটা ঘর জুড়ে শুধু বই আর বই- একজন বইপ্রেমীর মনের খোরাক যোগাতে আর কী চাই! কেবল বইপ্রেমী নয় পরিবারের ছোট থেকে বড় সকলের পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার জন্য বাড়িতেই চাই একটা ছোট্ট লাইব্রেরি। তবে শহুরে জীবনের ছোট পরিসরের ফ্ল্যাট বাড়িতে চাইলেই মনের মতো লাইব্রেরি গড়া যায় না। অনেক বাড়িতেই পড়ার জন্য, বইয়ের শেলফ রাখার জন্য আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করা যায় না। তাই ছোট গৃহকোণেই কী করে গড়তে পারেন একটা ‘শখের বইয়ের দুনিয়া’ চলুন তা দেখে নেয়া যাক।
বাড়িতে ছোট লাইব্রেরি গড়ে তোলার উপায়:
ঢাকার ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ইনফরমেশন স্টাডিজ এন্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও চেয়ারপার্সন ড. দিলারা বেগম বলেন, “বাড়িতে একটা লাইব্রেরি থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাড়িতে একটা ছোট লাইব্রেরি থাকলে খুব ছোটবেলা থেকেই শিশুদের বইয়ের সাথে সখ্য তৈরি হয়। একটা বাড়িতে সাধারণত শিশুরা থাকে, বয়োজেষ্ঠ্যরা থাকেন। সব সদস্যের চাহিদার কথা মাথায় রেখে তাদের উপযোগী বই দিয়ে লাইব্রেরি গড়ে তুলতে হবে যাতে বই পড়ার আনন্দের ভেতর দিয়েই জ্ঞানার্জন করা যায়। শখের লাইব্রেরিটি কোথায় করা হবে সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাড়ির একটা রুমকে লাইব্রেরি ও পাঠকক্ষ বানিয়ে নেয়া যেতে পারে। তবে এতোটা জায়গা না পাওয়া গেলে যে কোনো একটা কর্ণারকে কাজে লাগানো যেতে পারে। বেডরুম, লিভিং রুম বা ডাইনিংয়ের একটি কোণে, করিডোর, লবি কিংবা সিড়ির নিচে বই রাখার ও বসার ব্যবস্থা করেও বানিয়ে নেয়া যায় একটা শৌখিন লাইব্রেরি। আবার অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দারা ছাদের একটি কক্ষে অথবা সিড়ি ঘরে একটি কমিউনিটি লাইব্রেরি বানিয়ে ফেলতে পারেন।”
ড. দিলারা বেগম তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, “আমি আমার আপ্যার্টমেন্টের ছাদে কমন রুমে একটা বইয়ের শেলফ বসিয়ে তাতে কিছু বই, একটা ছোট টেবিল আর একটা চেয়ার রেখে লাইব্রেরি তৈরি করেছি। যেহেতু ব্যস্ততার কারণে সবার সাথে আমার দেখা হয় না , তাই সেখানে একটা বড় পোস্টারে ‘SHARE YOUR BOOK’ লিখে দিয়েছি। এরপর থেকে প্রতিদিন সবাই কিছু কিছু করে বই শেলফে রেখে যাচ্ছে। এমনি করেই একদিন শেলফটি বই দিয়ে পূর্ণ হয়ে যাবে। এখান থেকে যার যে বইটি পড়া হয়নি সে সেটি পড়ে ফেলতে পারবে। আপ্যার্টমেন্টের সবাই এই ব্যাপারটায় অনুপ্রাণিত হয়েছে, এটা আমার খুব ভালো লাগছে।”
অন্দরসজ্জায় বই:
আর্ক ভিজ লিমিটেডের প্রধান স্থপতি ও চেয়ারম্যান মেহেরুন ফারজানা জানালেন, “বাসায় আলাদা পড়ার ঘর করবার মতো জায়গা থাকলে সেখানে বুকশেলফ ও বসার ব্যবস্থা করা সম্ভব। তবে আজকাল ছোট ছোট বাসাগুলোয় আলাদা করে রিডিং কর্ণার বা রিডিং রুমের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয় না। তাই এখন ঘরের অন্দরসজ্জায় সবাই সমন্বিত আসবাবপত্র বেশি পছন্দ করছেন। সাধারণত লিভিং রুম বা বসার ঘরেই টিভি ক্যাবিনেটের সাথেই বইয়ের শেলফ করা যেতে পারে। ঘরের দেয়ালেই বিভিন্ন নান্দনিক ডিজাইনের শেলফ তৈরি করা হচ্ছে। ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, বৃত্তাকারসহ বিভিন্ন জ্যামিতিক ডিজাইন, গাছের আকৃতির বুকশেলফ ও ক্যাবিনেটও তৈরি করা হচ্ছে। বইয়ের তাকগুলোর উচ্চতা, আকারে ভিন্নতা আনা যেতে পারে। এর ফলে বিভিন্ন সাইজের বই যেমন রাখা সম্ভব হবে তেমনি গৃহসজ্জায় সৌন্দর্য ও আভিজাত্য বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া বড় শোবার ঘর থাকলে, সে ঘরের একটা দেয়াল জুড়ে বইয়ের ক্যাবিনেট ও একইসাথে পড়ার ব্যবস্থা করা সম্ভব। কাঁচ দিয়ে ঢাকা আলমারির চাইতে খোলা জায়গায় বই রাখা ভালো। তাতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচল করতে পারে, বই স্যাঁতসেঁতে হওয়া থেকে রক্ষা পায়। তাছাড়া খোলা জায়গায় বই থাকলে বাড়ির যে কেউ চাইলেই বই নিয়ে পড়তে পারে।
ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে বইয়ের ব্যবস্থাপনা:
বাড়িতে বইয়ের বিন্যাস ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে পরামর্শ দিলেন ড. দিলারা বেগম। তাঁর মতে, ‘‘প্রতিষ্ঠানিক লাইব্রেরিতে আমরা যেভাবে শ্রেনীবিন্যাস করে বই রাখি, বাড়িতে সেভাবে বই রাখা ততটা জরুরি নয়। বরং ব্যক্তিগত লাইব্রেরির ক্ষেত্রে একটু সহজ উপায়ে বইয়ের বিন্যাস করা যায়। সেটা হতে পারে বিষয়ভিত্তিক। যেমন: গল্প-উপন্যাস, কবিতা, ইতিহাস, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ের বই আলাদা আলাদা রেখে শেলফের গায়ে বড় বড় করে বিষয়ের নাম লিখে দেয়া যেতে পারে। আবার বিভিন্ন বিষয়ের বইয়ে বিভিন্ন রংয়ের স্টিকার লাগিয়ে চিহ্নিত করা যেতে পারে। যেমন: সব গল্প উপন্যাসের বইতে লাল রং, কবিতার বইগুলো নীল, অনুবাদগুলো সবুজ। এভাবে সাজালে বাড়ির ছোটরাও সহজে বইগুলো গুছিয়ে রাখতে পারে। আবার লেখক অনুযায়ীও বই সাজানো যেতে পারে। যেমন: একজন লেখকের সব বই একসাথে এক তাকে রাখা যেতে পারে। তবে বুকশেলফ রাখার পাশাপাশি আরাম করে বসে পড়ার ব্যবস্থা যেনো থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এছাড়া পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করাও খুব প্রয়োজন। বৃষ্টির ছাঁট ঘরে ঢোকে এমন জানালার পাশে বইয়ের শেলফ তৈরি করা বা রাখা যাবে না।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) গ্রন্থাগারিক ও বাংলাদেশ গ্রন্থাগার সমিতির সভাপতি ড. মো. মিজানুর রহমান ঘরে লাইব্রেরি তৈরি ও তার যত্নের ক্ষেত্রে কিছু আধুনিক ধারণার কথা জানালেন। তিনি বলেন, “এখনকার কনসেপ্ট অনুযায়ী বই থাকতে হবে পাঠকের হাতের নাগালে যেনো সে চাইলেই বই হাতে নিয়ে পড়তে পারে। এর ফলে বইয়ের উপযোগীতা বাড়ে। তাই এখন আলাদা পড়ার ঘরের বদলে বরং লিভিং রুমে বসার জন্য রাখা সোফা বা কাউচের আশেপাশেই বই রাখার ব্যবস্থা করা যায়। সোফার পাশে লো-হাইট ক্যাবিনেট, কর্ণার শেলফ তৈরি করে বিভিন্ন শো পিস, ফুলদানির সাথে কিছু বই সাজিয়ে রাখা যেতে পারে। বাসায় সংগ্রহের ক্ষেত্রে বইয়ের পরিমাণ দুই হাজার পাঁচশত থেকে তিন হাজারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকাই ভালো। এর চেয়ে বেশি বই বাসায় তত্ত্বাবধান করা কঠিন হয়। কালজয়ী ও ধ্রুপদী সাহিত্য, জীবনী, ইতিহাস, অনুবাদ সাহিত্য ইত্যাদি সংগ্রহের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেতে পারে।”