অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

রাতে ঘুম হয় নাঃ বিশেষজ্ঞরা কি বলছেন


নিদ্রাহীনতা (প্রতীকী ছবি)
নিদ্রাহীনতা (প্রতীকী ছবি)

রাকিবের বয়স ২২ বছর, পেশায় ছাত্র। গত একমাস ধরে খেয়াল করছে তার ঘুমের অনেক সমস্যা হচ্ছে। প্রতিদিন অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করে যখন সে ঘুমাতে যায় তখন তার আর সহজে ঘুম আসেনা। দীর্ঘসময় বিছানায় শুয়ে থাকার পরও ঘুম আসতে চায় না এবং খুব অস্থির অনুভব করে। খুব অল্প সময় ঘুম হওয়া নিয়েই তাকে পরের দিনের ক্লাসে অংশ নিতে হয়। কিন্তু সে ক্লাসে একদমই মনযোগ দিতে পারে না এবং প্রচন্ড ক্লান্তি বোধ করে।

মিসেস শায়লার বয়স ৪৪ বছর। তিনি একজন কর্মজীবী মা। খুব ভোরে উঠেই তাকে বাসায় সকালের নাস্তা তৈরি করে অফিসের জন্য তৈরি হয়ে বের হতে হয় এবং সারাদিন অফিসে প্রচন্ড কাজ কর্মে ব্যস্ত থেকে দিন শেষে বাড়ি এসে বাসার বাকি কাজ এবং পরিবারের সদস্যদের খেয়াল রাখতে হয়। সারাদিন অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা এবং মানসিক চাপ নিয়ে সব কাজ শেষ করে দিন শেষে যখন ঘুমাতে যান প্রায় দিনই তার ঘুম আসেনা এবং সারারাত জেগে থাকেন। ফলে দিন দিন তার নানাবিধ শারীরিক সমস্যা বাড়ছে এবং এবং তিনি খেয়াল করছেন আগের মতো তিনি সব কাজের কথা মনে রাখতে পারছেন না। মানসিকভাবেও তিনি ভেঙে পড়ছেন।

এদের দুজনই যে সমস্যাটিতে ভুগছেন তাকে অনিদ্রা বা ইনসমনিয়া বলে। ঘুমোতে না পারা বা ঘুম না আসাটাই এ সমস্যার মূল লক্ষণ। সারা বিশ্বে অসংখ্য মানুষের জীবনে এটি এখন জটিল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনা মহামারীর সময়গুলোতে এ সমস্যা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে।

স্বাস্থ্যগত প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা কোম্পানি ফিলিপস ১৩টি দেশের ১৩ হাজারের বেশি প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির আচরণ, সমস্যা, চিন্তাধারা এবং ঘুমের অভ্যাস নিয়ে জরিপ করেছে। ফিলিপস গ্লোবাল সার্ভের ২০২১ সালের জরিপ অনুযায়ী বিশ্বের শতকরা ৭০ ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ করোনাকালীন সময়ে তাদের ঘুমের সমস্যার কথা জানিয়েছেন। করোনাকালীন সময় থেকে ৩৭ ভাগ মানুষ অনিদ্রায় ভুগছেন বলে জানিয়েছেন। আমেরিকান স্লিপ অ্যাসোসিয়েশনের ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৭ কোটি আমেরিকানের ঘুমের সমস্যা রয়েছে। আমেরিকায় শতকরা ৩০ ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক লোক ঘুমের সমস্যায় ভোগেন।

বাংলাদেশ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দীন আহমদ বলেন, ‘‘অনিদ্রা বা ইনসমনিয়া হলো এক ধরণের স্লিপ ডিজঅর্ডার। দুই ধরণের স্লিপ ডিজঅর্ডার আছে। একটাকে বলা হয় ডিসমনিয়া আরেকটা হলো প্যারাসমনিয়া। ডিসমনিয়া হলো, ঘুম না আসা, বেশি ঘুম আসা, অথবা ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া এগুলো হলো ডিসমনিয়ার লক্ষণ। প্যারাসমনিয়া হলো ঘুমের ভেতর অস্বাভাবিক আচরণ করা। আমরা সাধারণত যেটাকে অনিদ্রা বা ইনসমনিয়া বলে থাকি, এটি আসলে ডিসমনিয়া গোত্রের অন্তর্গত। ঘুমের এক ধরণের সমস্যা যা স্লিপ ডিজঅর্ডারের সাথে সম্পৃক্ত। নানান কারণে ঘুমের সমস্যা হতে পারে। ঘুমের জন্য শরীরে মেলাটনিন হরমোন নিঃসৃত হয়। সাধারণত রাত ৯টা-১০টা থেকে শরীরে মেলাটনিন হরমোন নিঃসরণ শুরু হয় এবং সকাল ৬টা-৭টার মধ্যে এর নিঃসরণ বন্ধ হয়ে যায়। ক্রমাগত রাত জাগলে এবং দিনে ঘুমালে শরীরের এই সাইকেল এলামেলো হয়ে যায়। একে ডাক্তারি ভাষায় বলা হয় circadian rhythm sleep disorder. এটি অনিদ্রা রোগের একটি অন্যতম বড় কারণ।’’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ইশরাত শাহনাজ ইনসমনিয়া সম্পর্কে জানান, ‘‘যদি কোনো ব্যক্তি কোনো কারণে মাসে একদিন নিদ্রাহীন রাত কাটান সে ক্ষেত্রে কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। যদি কেউ প্রতি সপ্তাহে দুই থেকে তিনদিন অনিদ্রায় ভোগেন সেক্ষেত্রে কিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে সেটা ঠিক হয়ে যেতে পারে। আর যাদের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি অনিদ্রা, তিন মাসের বেশি সময় ধরে চলমান তাদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।”

অনিদ্রার উপসর্গ :

ইনসমনিয়ার কারণে যে সকল উপসর্গ দেখা যায় সেগুলো হলো,

- মাথা ব্যথা করা

- মাথা ঝিমঝিম করা

- শারীরিক দুর্বলতা

- কাজে মনোযোগ দিতে না পারা

- দিনের বেলা সারাক্ষণ ঘুম ঘুম লাগা

- মেজাজ খিটখিটে, রুক্ষ হয়ে যাওয়া

- স্মরণশক্তি হ্রাস পাওয়া

- স্বাভাবিক কাজকর্মের গতি হারানো

- কোনো কাজে উৎসাহ না পাওয়া, সবসময় মনমেজাজ খারাপ থাকা।

কেন হয় অনিদ্রার অসুখ:

ডা. হেলাল উদ্দীন আহমদের মতে, “ইদানিংকালে মানুষের জীবনযাত্রার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। মানুষের মধ্যে রাতে জেগে থাকা ও দিনে ঘুমানোর প্রবণতা বেড়েছে, যা অনিদ্রা রোগকে বাড়াচ্ছে। বেশ কিছু মানসিক সমস্যা যেমন, উদ্বিগ্নতা, বিষন্নতা, মানসিক চাপ ইত্যাদিও বেড়েছে। এসব থেকেও অনিদ্রা হতে পারে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি ব্যথার কারণেও অনিদ্রা হতে পারে।” এছাড়া মানুষের শরীরের হরমোনের পরিবর্তনের জন্যও ঘুমের সমস্যা হতে পারে।

অনিদ্রা থেকে মুক্তির উপায়:

অনিদ্রার সমস্যা থেকে মুক্তি এবং এ চিকিৎসা নিয়েও কিছু পরামর্শ দিয়েছেন ডা. হেলাল উদ্দীন আহমদ । তিনি বলেন,

- অনিদ্রা রোগের চিকিৎসার জন্য প্রথমেই আমাদেরকে ঘুমের সাইকেল ঠিক রাখতে হবে অর্থাৎ সঠিক সময়ে ঘুমাতে যেতে হবে।

- ঘুমের কিছু আদবকেতা রয়েছে যাতে স্লিপ হাইজিন বলা হয়। এই স্লিপ হাইজিন মেনে চলাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন: দিনের বেলা অকারণে বিছানায় শুয়ে থাকা যাবে না। শুয়ে শুয়ে টিভি দেখা, ল্যাপটপে কাজ করা, মুঠোফোন ব্যবহার পরিহার করতে হবে। এমনকি শুয়ে শুয়ে বইপত্র ও খবরের কাগজ বেশি না পড়াটাই ভালো। একজন ব্যক্তি দিনে যতবেশি বিছানায় শুয়ে থাকবে, তার ততবেশি অনিদ্রা রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।

- প্রত্যেকদিন কিছুটা সময় হাঁটাচলা, ব্যায়াম করতে হবে।

- সন্ধ্যার পর চা, কফি পান করা যাবে না।

- খুব বেশি রাত করে ব্যায়াম, গোসল করা যাবে না। এ ধরণের কাজ দেহের উদ্দীপনা বাড়িয়ে দেয় ফলে ঘুম কম হয়।

- কেউ কেউ দিনে ৭ থেকে ৮ ঘন্টা বা তার বেশি সময় ঘুমান আবার কেউ কেউ এর চেয়ে কম সময় ঘুমান। তবে ব্যক্তি কতক্ষণ ঘুমাচ্ছেন তার চেয়েও বেশি জরুরি তিনি ঘুমিয়ে সতেজ বোধ করছেন কি না।

- অতিরিক্ত ঘুমের সমস্যায় চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করা যাবে। তবে চিকিৎসকের নির্ধারিত মাত্রা অনুযায়ী, তিনি যে মেয়াদ নির্ধারণ করে দিবেন সে সময় পর্যন্ত ওষুধ সেবন করতে হবে। কখনওই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন করা যাবে না এং চিকিৎসক কর্তৃক নির্ধারিত মেয়াদের অতিরিক্ত সময় ধরে ওষুধ সেবন করা যাবে না। তাতে আসক্তি তৈরির সম্ভাবনা বাড়ে।

মনোবিজ্ঞানী ইশরাত শাহনাজ আরো কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। সেগুলো হলো,

- বিছানা, ঘরের তাপমাত্রা, আলো সবকিছু যেনো ঘুমোনোর উপযোগী বা আরামদায়ক হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থাৎ শোবার ঘরটাতে ঘুমোনোর উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

- খুব ক্লান্ত বোধ করলে দিনের বেলা ২০ মিনিটের দিবানিদ্রা দেয়া যেতে পারে।

- ঘুমোতে যাওয়ার অন্ততঃ এক ঘন্টা আগে সকল ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস যেমন ল্যাপটপ, টিভি, মুঠোফোন ইত্যাদির ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।

- ঘুমোতে গিয়ে সারাদিনের কাজকর্ম ও ঘটনাবলী কিংবা পরেরদিনের কাজ নিয়ে চিন্তা করা পরিহার করতে হবে।

- রিলাক্সেশন থেরাপি, মেডিটেশন, শ্বাসের ব্যায়াম ঘুমের সমস্যা কমানোর ক্ষেত্রে কার্যকর ভুমিকা রাখে। খুব ভোরে অথবা সন্ধ্যার পরে সব কাজকর্ম শেষে এ ধরণের চর্চাগুলো করা যেতে পারে।

- খুব প্রয়োজনবোধে কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি দেয়া যেতে পারে।

XS
SM
MD
LG