অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

সাক্ষাতকারঃ আহমেদ মুশফিক মোবারক


আহমেদ মুশফিক মোবারক
আহমেদ মুশফিক মোবারক

কোভিড মহামারী নিয়ন্ত্রণে মাস্ক ব্যবহারের উপর এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় গবেষণাটি করা হয়েছে বাংলাদেশে। গবেষক দলের মধ্যে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আহমেদ মুশফিক মোবারক। এই গবেষণাটির উপর ভিত্তি করে সম্প্রতি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মাস্ক ব্যবহার বিষয়ে বেশ কিছু সুপারিশ প্রদান করেছে। এছাড়াও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) এই গবেষণার তথ্য ব্যবহার করে তাদের সুপারিশও হালনাগাদ করেছে। এই গবেষণা এবং তার অন্যান্য সাম্প্রতিক গবেষণা সহ আরও বেশ কিছু বিষয় নিয়ে ভয়েস অফ আমেরিকার বাংলা বিভাগ এর সাথে কথা বলেন আহমেদ মুশফিক মোবারক। অনলাইনে এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আলী নাসিক আইমান।

ভয়েস অফ আমেরিকা: সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আপনাদের একটি গবেষণার বিষয় উল্লেখ করে মাস্ক ব্যবহারের বিষয়ে বেশ কিছু সুপারিশ প্রদান করেছে। আমাদের এই গবেষণার বিষয়ে একটু বিস্তারিত জানাবেন।

আহমেদ মুশফিক মোবারক: এই মহামারী যখন ২০২০ সালে আরম্ভ হলো, তখন থেকেই আমাদের একটা আগ্রহ ছিল এটা বোঝার যে কি ধরণের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক আচরণ সারা দেশব্যাপী লোকজন অনুসরণ করছে বা আদৌ করছে কিনা। তখন আমরা ২০২০ সালের মার্চ মাসে, দেশব্যাপী (বাংলাদেশ) বিভিন্ন গ্রামেগঞ্জে ফোনের মাধ্যমে কিছু তথ্য সংগ্রহ করা শুরু করেছিলাম। সংগ্রহ করা তথ্য থেকে দেখা গেল যে, মাস্ক সঠিকভাবে পরার অভ্যাসটা তৈরি করা কিন্তু সহজ নয়। সেই সূত্রেই একটা নতুন গবেষণার গুরুত্ব চলে আসল। সেটা হল যে, আমরা কিভাবে মাস্ক পরার অভ্যাসটা আনতে পারি। সেই কারণেই আমরা দেশের ৬০০টি ইউনিয়নে, প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষের সাথে একটা গবেষণা আরম্ভ করি। প্রতিটি ইউনিয়নে একটি গ্রামে এই গবেষণা চালানো হয়। এই ৬০০টির মধ্যে ৩০০টিতে, যেটাকে ট্রিটমেন্ট গ্রুপ বলে, সেখানে আমরা বিভিন্ন পদ্ধতিতে মানুষের মাস্ক পরার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য চেষ্টা করি। আর অন্য ৩০০টি কন্ট্রোল গ্রুপ ছিল। সেভাবেই এই গবেষণার ফলাফল এসেছে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: গবেষণাটির শেষে আপনারা কি ফলাফল পেয়েছিলেন?

আহমেদ মুশফিক মোবারক: আমাদের গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল দুইটি। তার মধ্যে একটি হল কিভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে মাস্ক পরার অভ্যাস গড়ে তোলা যায়।

মাস্ক পরার অভ্যাস গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমরা অনেক ধরণের কৌশল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছি। তারপর আমরা চারটি কৌশলের সমন্বয়ে একটা নতুন পদ্ধতি তৈরি করেছি। সেটাকে আমরা বলি NORM। ইংরেজিতে NORM শব্দটির বাংলা মানে হল রীতি। আর সেই চারটি পদ্ধতি একসাথে যদি বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে মাস্কের অভ্যাস চলে আসে।

সেই চারটি পদ্ধতির প্রথমটি হল বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণ। দ্বিতীয়টি হল সঠিকভাবে মাস্ক পরার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা ও তথ্য প্রদান করা। তৃতীয়টি হল রাস্তায় বা জনপরিসরে যদি কোন ব্যক্তি মাস্ক ব্যবহার না করেন, তাহলে তাকে মনে করিয়ে দেওয়া যে সঠিকভাবে মাস্ক পরাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর চতুর্থটি হল যে স্থানীয় নেতাদের মাধ্যমে মাস্ক পরার একটা দৃষ্টান্ত তুলে ধরা। এই চারটি যদি সমন্বয় করে প্রয়োগ করা যায়, তাহলে দেখা যায় যে মাস্ক পরাটা একটা রীতিতে চলে আসে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: আপনারা যে পদ্ধতিটা সুপারিশ করছেন, তার প্রথম বিষয়টি হল বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণ করা। সে বিষয়ে কি কোন ধরণের কাজ হচ্ছে?

আহমেদ মুশফিক মোবারক: যদি আমরা একটা দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন আনতে চাই তাহলে আমার মনে হয় যেই চারটি পদ্ধতির কথা বললাম, সেই চারটি কাজই করা প্রয়োজন। আর তার মধ্যে বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণে গবেষণা যখন শেষ হল এবং আমি ফলাফলটা পেলাম, তখনই আমি কাজ আরম্ভ করে দিয়েছিলাম যে কিভাবে আমরা খুব বড় আকারে সারা দেশব্যাপী বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণ করতে পারি। সেই কাজটা করতে আমরা (বাংলাদেশের) স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং ব্র্যাক-এর সাথে একত্র হয়ে একটা নতুন পরিকল্পনা তৈরি করেছি।

যেহেতু আমাদের (বাংলাদেশের) জনসংখ্যা অনেক বেশি সেহেতু অনেক মাস্কের প্রয়োজন। হেইনস নামে আমেরিকার একটি কোম্পানীর মাধ্যমে আমি বড় ধরণের একটা উপহার পেয়েছি। তারা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য প্রায় ১১ কোটি মাস্ক আমাদেরকে দিয়েছে। আমরা ব্র্যাকের সাথে কথা বলে ঐ ১১ কোটি মাস্কের মধ্যে প্রায় ৭-৮ কোটি বাংলাদেশে পাঠিয়েছি। আর বাকিগুলো ভারতে, পাকিস্তানে, আর নেপালে যাচ্ছে। সেই মাস্কগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছেছে। আর ব্র্যাকের সারা দেশে যেই অবকাঠামোটি রয়েছে, সেই অবকাঠামো ব্যবহার করে আমরা সেই মাস্কটা এখন বিতরণ করছি।

ভয়েস অফ আমেরিকা: বাংলাদেশ ব্যতীত আর কেউ কি এই গবেষণা ব্যবহার করে মাস্ক ব্যবহারের বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নিয়েছে? কোন ধরণের মাস্ক সবচেয়ে বেশি কার্যকর?

আহমেদ মুশফিক মোবারক: আমরা গবেষণার সময় দুইটি ভিন্ন ধরণের মাস্ক ব্যবহার করেছিলাম। একটা হল সার্জিক্যাল মাস্ক, আরেকটা হল কাপড়ের মাস্ক। আমাদের পরীক্ষায় দেখা গেল যে, সার্জিক্যাল মাস্ক কিন্তু কাপড়ের মাস্কের তুলনায় আরো বেশি ভাল কাজ করে কারণ সার্জিক্যাল মাস্কের ফিল্টার করার ক্ষমতা অনেক বেশি। সার্জিক্যাল মাস্কের ক্ষেত্রে এটি ৯০-৯৫%, যেটি কাপড়ের মাস্কের ক্ষেত্রে মাত্র ৪০%। কিন্তু বাংলাদেশের অনেকের মত ছিল যে আসলে সার্জিক্যাল মাস্ক লোকজন পছন্দ করবে না। সেজন্য আমাদের মনে হল যে, গবেষণার সময় পাশাপাশি দুইটিই তুলনা করে দেখি। দেখা গেল যে, মানুষ সার্জিক্যাল মাস্ক ভালই ব্যবহার করে এবং পছন্দও করে।

আর বাংলাদেশ ছাড়া, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) আমাদের গবেষণাটিকে উদ্ধৃত করে তাদের সুপারিশমালা হালনাগাদ করেছে। তারা বলছেন যে, সার্জিক্যাল মাস্কই ব্যবহার করা উচিৎ। তাছাড়াও বাংলাদেশের কাজটা হওয়ার পরে, ভারতের গুজরাট, রাজস্থান, পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশে এই একই মডেলটা আমরা প্রয়োগ করেছি।

ভয়েস অফ আমেরিকা: এর পরে আপনারা কি আর কোনও বিষয়ে গবেষণা করেছেন?

আহমেদ মুশফিক মোবারক: (আমরা) এই একই গবেষণা দল এখন, কিভাবে নিম্ন বা মধ্যম আয়ের দেশে টিকার হার বাড়ানো যায়, সেই বিষয়ে কাজ করছি। এই কাজটা করা খুব প্রয়োজনীয়। অনেকে মনে করেন যে, টিকা নেওয়ার ব্যাপারে অনেক মানুষ হয়ত একটু সংশয় বোধ করেন। সেই কারণে হয়ত টিকা নেওয়ার হার বিভিন্ন দেশে কম। সেটা একটা কারণ হতে পারে, তবে সেটাই একমাত্র কারণ নয়।

আমরা গবেষণা করে দেখেছি, নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে টিকা গ্রহণে দ্বিধা কিন্তু আমেরিকার তুলনায় অনেক কম। কিন্তু আমরা যদি গ্রামেগঞ্জে গিয়ে টিকা পৌঁছতে চাই, সেটার জন্য একটা অবকাঠামো দরকার। সেই অবকাঠামোগুলো কিন্তু আমরা ঠিকমত গড়ে তুলতে পারিনি। আমি সিয়েরা লিওনে যে কাজ করছি, সেখানে একটা গ্রামের লোকদেরকে যদি আমরা টিকা প্রদান করতে চাই, তাহলে সেখানকার লোকজনকে প্রায় এক-দুই দিন ধরে কাছাকাছি কোন মফস্বল শহরে গিয়ে টিকা নিতে হয়। সেটাতে কিন্তু তারা করতে রাজি না। কারণ তাতে যাতায়াত খরচ প্রায় ৭-৮ ডলার লাগে। আর এমন একটা দেশে যেখানে অনেকেই প্রতিদিন দেড় ডলারের নিচে আয় করেন, সেখানে স্বাভাবিকভাবেই এমন অবস্থায় তারা টিকা নিতে চাইবেন না। তো সেইজন্য আমরা চেষ্টা করছি টিকাগুলোই বিভিন্ন গ্রামেগঞ্জে পৌঁছে দেওয়ার। সেই কাজটা এখন চলছে সিয়েরা লিওনে, ভারতের বিহারে, এবং পাকিস্তানে। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হল এটা দেখানো যে, স্বল্প ব্যয়ে সব দেশের সব জায়গায় এই টিকা পৌঁছানো সম্ভব। সেটা যদি আমরা দেখাতে পারি, তখন আমরা গিয়ে ডব্লিউএইচও বা ফাইজারকে বলতে পারি যে, এখানে এখন অবকাঠামো এখন তৈরি হয়েছে তাই এখানে এখন টিকা পাঠানো প্রয়োজন।

লাস্ট মাইল ডেলিভারী আসলে একটা বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ। সেই কারণে হয়ত অনেকের মনে হয় যে টিকা গ্রহণে দ্বিধা রয়েছে। আসলে কিন্তু সেটা নয়। সেটা হল অবকাঠামোর সমস্যা, সহজলভ্যতার সমস্যা – সেটা টিকা গ্রহণে দ্বিধা নয়।

ভয়েস অফ আমেরিকা: আপনার বেড়ে ওঠা ও শিক্ষাজীবন সম্পর্কে আমাদের একটু বলবেন?

আহমেদ মুশফিক মোবারক: আমার দাদার বাড়ি (বাংলাদেশের) নওগাঁ। আর দেশভাগের আগে আমার মায়ের বাড়ি ছিল পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে। তবে আমার নানীর বাড়ি ফরিদপুরের কাছে রাজবাড়ীতে। আমি ঢাকাতেই বড় হয়েছি। ঢাকায় আমি সেন্ট যোসেফ স্কুলে পড়তাম। স্কুল শেষে আমি কিছুদিন ভারতে পড়তে গিয়েছিলাম। আর তারপরে আমেরিকায় চলে এসেছিলাম উচ্চশিক্ষার জন্য।

XS
SM
MD
LG