পিঠা বাংলার চিরায়ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি অংশ। শীত আর পিঠা একে অপরের পরিপূরক।
এ সময় কৃষকেরা তাদের ঘরে নতুন ধান তোলেন। এরপর নতুন ধানে নতুন নতুন পিঠাপুলি তৈরির হিড়িক পড়ে যায়। মা, চাচি, খালা, বোন, ভাবিরা পিঠা তৈরি করেন। চারদিকে পিঠার উৎসব শুরু হয়। নতুন চালের ধোঁয়া ওড়ানো গরম গরম পিঠা খাওয়ার মজাই আলাদা।
বাংলাদেশে প্রতি বছর বিভিন্ন উৎসবে পিঠাপুলির আয়োজন দেখা গেলেও পিঠা খাওয়ার মৌসুম কিন্তু শীতকালেই। নতুন চাল, খেজুরের রসের নতুন গুড়ে টইটম্বুর পিঠা বাঙালির শীত উদ্যাপনকে করে তোলে রঙিন।
বাংলা পৌষ মাসে (ডিসেম্বর–জানুয়ারি) নতুন চালের গুঁড়োয় পিঠা তৈরির যে উৎসব হয়, তাকে পৌষ পার্বণ বলে। পিঠা বাংলার লোকসংস্কৃতির অনুষঙ্গ।
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তার “বঙ্গীয় শব্দকোষ”–এ লিখেছেন, “পিঠা হলো চালের গুঁড়া, ডাল বাটা, গুড়, নারিকেল ইত্যাদির মিশ্রণে তৈরি মিষ্টান্নবিশেষ”। যেহেতু বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য ধান, তাই চালের গুঁড়া পিঠা তৈরির মূল উপকরণ হিসেবে ব্যবহার হয়। এছাড়া পিঠা তৈরির উপাদানের মধ্যে আছে ময়দা, নারিকেল, খেজুরের রস, খেজুরের গুড়, আখের গুড়, দুধ, তেল ইত্যাদি। কখনও কখনও সবজি ও মাংসও পিঠা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
পৌষসংক্রান্তি, নবান্ন, ধর্মীয় উৎসবসহ বিভিন্ন সামাজিক উৎসব ও রীতি-নীতি পালনের ক্ষেত্রেও পিঠার ব্যবহার হয়ে থাকে। যেমন-বিয়ে, গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান, নাইওর বা ফিরানি, অষ্টমঙ্গলা, মুখে ভাত, সুন্নত-এ খাতনা, সাতোশা, নববর্ষ, সাকরাইন, অতিথি আগমন ইত্যাদি।
একসময় বিয়ের পরে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় গুড়-মুড়ি-চিড়ে, পান-সুপারির সঙ্গে পাঠানো হতো বিশাল ডালাভর্তি অথবা রঙিন হাঁড়িভর্তি ফুলপিঠা, পাক্কন পিঠা।
নকশি পিঠা, পাক্কান পিঠা, ফুল পিঠা ঢাকা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে বেশি তৈরি হয়। চালের খামির বানিয়ে মোটা মোটা করে বেলে তার ওপরে খেজুর কাঁটা দিয়ে একটু গভীর করে আলপনা আঁকা হয়। পাক্কন বা মুগপাক্কনও সুঁই কাটা দিয়ে নকশা করা পিঠা। তবে এর গোলাতে মুগ ডাল লাগে।
ঢাকার বিয়েতে থাউকা বড়া নামের একটি পিঠা থাকে যা অঞ্চলভেদে পুয়া, মালপোয়া, ভাজা পিঠা, তেলের পিঠা ইত্যাদি নামে পরিচিত।
আর একটি জনপ্রিয় সামাজিক অনুষ্ঠান “সাতোশা”। অঞ্চলভেদে একে “সাধ” বলা হয়ে থাকে। বিয়ের পর মেয়েরা প্রথমবার অন্তঃসত্ত্বা হয়ে বাবার বাড়ি এলে বাবার বাড়ির লোকজন উৎসবটির আয়োজন করে। গর্ভের সন্তানের বয়স যখন সাত মাস হয় তখন অনুষ্ঠান করা হয়। এসময় চন্দ্রপুলি পিঠা তৈরি করা হয়। এই পিঠায় মিহি করে কোরানো নারিকেল অথবা শিল পাটায় বাটা নারিকেলের সঙ্গে চিনি বা গুড় মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে হালুয়ার মতো আঠালো পুর তৈরি করে রুটির ভেতরে পুর ভাঁজ করে অর্ধচন্দ্রাকৃতির আকার দেওয়া হয়।
সাতোশা এবং ঈদ-উল-ফিতরে কাটা সেমাই পিঠা বা হাত সেমাই পিঠা তৈরি করতে দেখা যায়। খেজুরের গুড়, দুধ ও নারিকেল দিয়ে রান্না করা হয় এই সেমাই পিঠা। গ্রামাঞ্চলে কড়া রোদে শুকিয়ে পিঠা বৈয়ামে তুলে সংরক্ষণও করা হয়।
চিতই পিঠা বাংলাদেশের সব অঞ্চলের ধনী-দরিদ্র সবার কাছে পরিচিত ও প্রিয়। শহরের অলিগলিতেও দেখা যায় এ পিঠা। অনেক রকম ভর্তা দিয়ে চিতই পিঠা খাওয়া হয়; আবার মাংসের ঝোল, কলিজা ভুনা, হাঁস ভুনার সঙ্গেও দিব্যি চলে চিতই পিঠা। চিতই পিঠা খেজুরের রস বা খেজুরের রসযুক্ত দুধে ভিজিয়ে তৈরি হয় দুধ চিতই বা ভিজা পিঠা। দুধ চিতই মূলত পৌষপার্বণ ও নবান্ন উৎসবের পিঠা।
জনপ্রিয় আরেকটি পিঠা হলো ভাপা পিঠা। কোথাও কোথাও এ পিঠা ধুপি পিঠা বা ধুকি পিঠা নামে পরিচিত। বাষ্পে সিদ্ধ করা হয় বলে এই পিঠার নাম ভাপা পিঠা। চালের গুঁড়ো দিয়ে করা ছোট ছোট পিঠার মাঝখানে খেজুরের রসের নতুন গুড় আর নারিকেল থাকে। ভাপা পিঠা মোগল আমলে ঢাকার অন্যতম পিঠা ছিল। সেই পিঠায় দেওয়া হতো ঘি, জাফরান, মালাই, খিরসা, পেস্তা বাদাম, মোরব্বা আর যশোরের খেজুরের গুড়, সুগন্ধি চাল। এই পিঠাগুলো আকারে বড়। তাই বলা হতো শাহি ভাপা পিঠা।
ঢাকা ও এর আশেপাশের অন্য অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী পিঠার মধ্যে পাটিসাপটা, গুজা পিঠা, ডালরুটি, ছিটপিঠা, ছানার মালপোয়া, বিবিখানা পিঠা, কলা পিঠা, দুধ পুলি, মুখশলা পিঠা, চাপড়ি পিঠা, লবঙ্গ লতিকা, মুঠি পিঠা, খেজুর পিঠা, ডিমের ঝাল পুয়া, ঝাল পাটিসাপটা, তিল পুলি, সাবুর পিঠা, ম্যারা পিঠা, ছিটরুটি অন্যতম।
নোয়াখালী, কুমিল্লা অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহি পিঠার মধ্যে অন্যতম খোলাজা পিঠা, ম্যাড়া পিঠা, নারিকেল পুলি পিঠা, ডিমের পানতোয়া, নারিকেলের চিড়া।
চট্টগ্রামের ঐতিহ্য বিন্নি ভাত বা মধু ভাত। এছাড়া স্থানীয়রা কলা, নারিকেল, বিন্নি চাল, চিনি দিয়ে কলাপাতায় মুড়ে ভাপে পিঠা তৈরি করে যার আঞ্চলিক নাম আতিক্কা পিঠা। আবার বিন্নি চালের গুঁড়োয় গুড় আর নারিকেল মিলে তৈরি হয় বিন্নি পুলি।
বিবিখানা পিঠার জন্য বিখ্যাত শরিয়তপুর।
রান্না করা মাংস, চালের গুঁড়া, পেঁয়াজ, মরিচ সব মিশিয়ে জামালপুরে তৈরি হয় রোট পিঠা।
সিলেটের গ্রামাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাবার চুঙ্গাপুড়া পিঠা। একসময় শুধু পাহাড়ি আদিবাসীদের খাবার ছিলো এটি। পরে সমতলের মানুষও এই খাবার তৈরি করতে শিখে যায়। সিলেটের আরেকটি প্রচলিত পিঠা নোনতা বা নুনগড়া পিঠা।
খুলনা, বাগেরহাট অঞ্চলের মানুষের প্রিয় হাত সেমাই পিঠা। এ পিঠা ভাপে সেদ্ধ করে হাঁস ভুনা দিয়ে খাওয়া হয়।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ রকম অসংখ্য ঐতিহ্যবাহী নাম জানা-না জানা পিঠা ছড়িয়ে আছে। অঞ্চল ভেদে পিঠার নাম পাল্টে যায়, প্রস্তুতপ্রণালিতে আসে ভিন্নতা। শীতকালে সবখানেই পিঠামেলা বা পিঠা উৎসবের আয়োজন করা হয়। আবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নয় মাসই চলে পিঠা উৎসব।
আজকাল শহরের অভিজাত রেস্তোরাঁতেও গ্রামবাংলার পিঠাপুলি জায়গা করে নিয়েছে। আবার দ্রুততম নাগরিক জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে ইনস্টান্ট ও ফাস্টফুডের দাপট দখল করে নিয়েছে পিঠাপুলির জায়গা। তাই অনেক পিঠাই হারিয়ে যাচ্ছে। গ্রাম বাংলার মা, চাচি, খালা, বোন, ভাবিদের চিরায়ত সেই ঐতিহ্য নগরজীবন থেকে হারিয়ে যাওয়ার পথে। তবু শীতকাল এলে উৎসবপ্রিয় বাঙালির ঘরে দু–এক পদের শীতের পিঠার দেখা মেলে। আর যতকাল বাংলার মানুষের জীবনে উৎসব আছে ততকাল উৎসবের অনুষঙ্গ হিসেবেই বেঁচে থাকবে পিঠা সংস্কৃতি।