সাম্প্রতিক কালে ‘রাতের রাণী’ কথাটি বাংলাদেশের গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আলোচিত হচ্ছে। নানান পেশায় নিয়োজিত কয়েকজন নারীর গ্রেপ্তারের পর কোন কোন মিডিয়ায় তাদের “রাতের রাণী” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এর প্রতিবাদে ‘মেয়ে নেটওয়ার্ক’ নামে একটি নারীবাদী তৃণমূল সংগঠনের ফেসবুক পেজ থেকে ‘রাতের রানী’ নামে প্রোফাইল ছবির ফ্রেম তৈরি করা হয় গত ১৪ অগাস্ট। অনেকেই পরীমনি, মৌ, পিয়াসাদের নিয়ে মোরাল পোলিসিং ও মিডিয়া ট্রায়ালের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ রূপে এই ফ্রেম ব্যবহার করছেন।
রাতের রানী, ইংরেজিতে ‘কুইন অফ দ্যা নাইট’ একটি ফুল যার বৈজ্ঞানিক নাম এপিফিলাম অস্কিপেটলাম। রূপে-গন্ধে অতুলনীয় সাদা রঙের এই ফুলটি ফোটে বছরে কেবল একদিন, শুধু রাতের বেলায়। ভোর হলেই ঝরে পড়ে।
মনমাতানো সেই বিরল ফুলের নাম থেকে ‘রাতের রানী’ আজ পরিণত হয়েছে শ্রুতিকটু ‘পতিতা’ আর ‘বেশ্যা’র সমার্থক শব্দে। কিছু শক্তিশালী মহলের স্বার্থ রক্ষার্থে জনগুরুত্বপূর্ণ নানান বিষয় থেকে নজর সরানোর উদ্দেশ্যে এহেন চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী সংবাদ ফলাও করে প্রকাশ করা হচ্ছে কি না, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সে বিতর্ক চলমান। ইউটিউব ও ফেসবুক ভিডিওতে চলছে বিশেষজ্ঞদের আলোচনা অনুষ্ঠান।
‘মেয়ে নেটওয়ার্ক’-এর পেজে ‘রাতের রানী’ ফ্রেমটি সম্পর্কে বলা হয়, “মেয়েরা ঘর থেকে বের হবে। দিনে রাতে যখন খুশি বাইরে যাবে। সন্ধ্যার পরে বাইরে গেলে যদি মেয়েদেরকে রাতের রানী ডেকে কটাক্ষ করা যায়, তবে আমরা সবাই রাতের রানী।” ফেসবুকের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২১ অগাস্ট পর্যন্ত এ ফ্রেমের ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১০০ ছাড়িয়েছে বলে জানান ফ্রেমটির ডিজাইনার প্রকৌশলী তৃষিয়া নাশতারান।
ভয়েস অফ আমেরিকাকে তিনি বলেন, “বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে অর্থনৈতিক অবস্থান এবং লিঙ্গের ভিত্তিতে প্রান্তিকতা প্রকট, সেখানে মোরাল পোলিসিং একজন প্রান্তিক মানুষকে আরো বিপন্ন করে তুলতে পারে।”
মোরাল পোলিসিং সকল সমাজেই ক্ষতিকর বলে মন্তব্য করেন নাশতারান। নৈতিকতা আপেক্ষিক একটি ব্যাপার। একেকজনের ব্যক্তিগত ঠিক-ভুলের ধারণা একেক রকম হতে পারে। যে সমাজে ভুল এবং অপরাধের কোনো নির্ধারিত সীমারেখা থাকে না, সেখানে আইনের চোখে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগেই একজন ব্যক্তির জীবন ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও পেশাগত পর্যায়ে কলুষিত হয়ে উঠতে পারে বলে তিনি দাবী করেন।
নাশতারান আরও বলেন, “এদেশে একজন নারীকে হেয় প্রতিপন্ন করার সহজতম পথ হলো তার ব্যক্তিগত চরিত্রে আঘাত করা, নারীর যৌনজীবন নিয়ে প্রশ্ন তোলা। এ ধরনের মোরাল পোলিসিং যে শুধুমাত্র মানুষ হিসেবে নারীর অধিকার ও সম্মান লংঘন করে তা-ই নয়, বরং সকল নারীর জন্য চলার পথকে আরো কণ্টকাকীর্ণ করে তোলে। তাই এই মোরাল পোলিসিংয়ের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান।”
ভিকারুন্নিসা নূন কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ফাইজা ফাইরুজ রিমঝিম তাঁর ফেসবুক প্রোফাইলে জুড়ে দিয়েছেন ‘রাতের রানী’ ফ্রেমটি। পুরুষতান্ত্রিকতা-বিচারহীনতার সমাজে পরীমনি সহ সকল অভিযুক্ত নারীর সাথে সহমর্মিতা দেখাতে এ কাজ করেন বলে জানান তিনি।
১৮৭২ সালে প্রণীত সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা অনুসারে, কোনো ব্যক্তি যখন বলাৎকার বা শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে ফৌজদারিতে সোপর্দ হন, তখন দেখানো যেতে পারে যে ‘অভিযোগকারিণী’ সাধারণভাবে দুশ্চরিত্রা। ইতোমধ্যে, বাংলাদেশ লিগাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এবং অন্যান্য অনেক সংগঠন আইনের এই ধারাটি বাতিলের দাবীতে কথা বলেছেন। সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, গত সেপ্টেম্বরের সংসদ অধিবেশনে সাক্ষ্য আইন বাতিল হবে বলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আশ্বাস দিয়েছেন।
এদিকে, ইন্টারনেট ও ফেসবুকের যুগে পাঠকদের আকৃষ্ট করতে মুখরোচক শব্দাবলী এবং রসালো খবরের চল বেড়েছে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এক সহযোগী অধ্যাপক। কেউ নেতিবাচক বিশেষণ যুক্ত করে বক্তব্য দিলেও তা ফলাও করে প্রচার করা বা ‘ক্লিক বেইট’ শিরোনাম তৈরি করাকে সাংবাদিকতার নৈতিকতার বিরোধী বলে তিনি অভিমত ব্যাক্ত করেন।
“সুড়সুড়ির দিন শেষ” বলে দাবী করেন, একটি অনলাইন সংবাদ মাধ্যমের ইংরেজি ডেস্কের সহ-সম্পাদক ও নন-বাইনারি এক্টিভিস্ট, রজনী রওজা। নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া এড়াতে দায়িত্বহীন সাংবাদিকতা বর্জন আবশ্যক, বলেন তিনি।
রওজা নিজেও তাঁর ফেসবুক প্রোফাইল ছবিতে ‘রাতের রানী’ ফ্রেমটি সংযুক্ত করেছেন। নারী বা যৌন বৈচিত্র্যময় মানুষকে "মানুষ" মনে না করে শুধুই ভোগ্যবস্তু মনে করাকে, এ সমাজের প্রধান সমস্যা বলে চিহ্নিত করেন রওজা। তাঁর মতে পাঠ্যক্রমে যৌনশিক্ষার প্রবর্তনের পাশাপাশি পারিবারিক পর্যায়ে পুরুষতান্ত্রিকতাসৃষ্ট সভ্যতা বিবর্জিত চিন্তা-চেতনার আমূল পরিবর্তন করা আবশ্যক।