জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ানোর জেরে বাংলাদেশে পরিবহন মালিকদের ধর্মঘটে চরম জনদুর্ভোগ দেখা দিয়েছে। দূরপাল্লার বাস ও পণ্য পরিবহনের ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান চলাচল বন্ধ থাকায় নানামুখী সংকট তৈরি হয়েছে। শুক্রবার থেকে অঘোষিত এই ধর্মঘট শুরু হয়। শনিবার নতুন করে লঞ্চ ধর্মঘট ডাকায় জনদুর্ভোগ আরও বেড়েছে। দুই দিনেও চলমান অচলাবস্থার কোনো সুরাহা হয়নি। শনিবার দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির নেতারা বৈঠক করলেও কোনো সমাধান আসেনি।মালিক সমিতির নেতারা বৈঠক শেষে জানিয়েছেন, জ্বালানি তেলের মূল্য কমানো বা বর্ধিত দামের সঙ্গে পরিবহন ভাড়া সমন্বয় করার আগ পর্যন্ত তারা ধর্মঘট চালিয়ে যাবেন।
ধর্মঘট অব্যাহত থাকায় সারা দেশ কার্যত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।জরুরি প্রয়োজনে মানুষ ট্রেন বা ছোট ছোট যানবাহনে করে এক জেলা থেকে অন্যজেলায় যাচ্ছেন। রাজধানীতে কোনো গণপরিবহন চলছে না। এতে বিপাকে পড়েছেন কর্মজীবী মানুষ। রাষ্ট্রায়ত্ত বিআরটিসির কিছু বাস চলাচল করলেও এতে সব যাত্রী উঠতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে অনেকে বাড়তি ভাড়া দিয়ে রিকশা বা অন্য কোনো ছোট যানে করে নিজ নিজ গন্তব্যে যাচ্ছেন।
শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া পরিবহন ধর্মঘটের প্রভাব পড়েছে নিত্যপণ্যের বাজারে। ইতিমধ্যে অনেক পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। বিশেষ করে কাঁচাপণ্য, চালসহ বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেশি নেয়া হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান চলাচল বন্ধ থাকায় পণ্য সরবরাহ কমে গেছে।এতে দাম বেড়ে যাচ্ছে।এমন পরিস্থিতিতে রোববার জ্বালানি তেলের বাড়তি মূল্যের সঙ্গে পরিবহনের ভাড়া সমন্বয় করতে একটি বৈঠক আহ্বান করেছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি-বিআরটিএ। ওই বৈঠকে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বৈঠকে ভাড়া সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
বৈঠকের বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মশিউর রহমান রাঙা বলেন, বৈঠকে তার সংগঠনের প্রতিনিধি অংশ নেবেন। পরিবহনের ভাড়া বাড়াতে না জ্বালানি তেলের দাম কমানোর দাবিতে ধর্মঘট ডাকা হয়েছে তাজানতে চাইলে তিনি বলেন, "আমরা একটা সমন্বয় চাই। তার মতে, জ্বালানি তেলের মূল্য যে পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে সে অনুযায়ী পরিবহন ভাড়া বাড়ানো হলে এর প্রভাব জনজীবনে পড়বে। এতে বিপর্যয় নেমে আসবে।"
বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সাধারণ সম্পাদক রাকেশ ঘোষ বলেন,"জ্বালানি তেলের দাম যেহেতু বাড়ানো হয়েছে তাই আমরা ৫০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর দাবি জানিয়েছি। রোববারের বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসবে বলে আমরা আশা করছি।"
ডিজেলের দাম বাড়ানোর পর প্রথম দুইদিন চলাচল করলেও শনিবার দুপুর থেকে লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো ঘোষণা না আসলেও দুপুরের পর পন্টুন থেকে লঞ্চ সরিয়ে নিয়েছেন মালিকরা। তারা বলছেন, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে ভাড়া সমন্বয় না করলে লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকবে।
ধর্মঘটের কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য পরিবহন বন্ধ রয়েছে। ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিনে শনিবার বন্দরে কোনো কন্টেইনার ওঠানামা করেনি। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, ধর্মঘটের কারণে শনিবার সকাল থেকে কোনো ডেলিভারি হচ্ছে না। বেসরকারি ডিপো থেকে কোনো কন্টেইনারও বন্দরে আসছে না। ধর্মঘট অব্যাহত থাকলে বন্দরে কন্টেইনার জট দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
যাত্রীদের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে চট্টগ্রাম মহানগরীতে রোববার সকাল থেকে বাস চলাচল করবে বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন বাস মালিক সমিতি। সমিতির সভাপতি বেলায়েত হোসেন বেলাল জানিয়েছেন, "মালিক সমিতির শান্তিপূর্ণ ধর্মঘট চলাকালে শ্রমিকদের নামে কিছু মানুষ সড়ক অবরোধ করে মানুষের ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলে বাধা দিয়েছে। ভাঙচুর করেছে। তারা মানুষকে বিপর্যয়কর অবস্থায় ফেলে দিতে চাইছে। এ কারণে আমরা রোববার থেকে গাড়ি চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।"
ওদিকে জ্বালানি তেলের বাড়তি মূল্য ও পরিবহন ধর্মঘট দুটোই প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সংগঠনটি বলছে, করোনাভাইরাস মহামারির বিপর্যয় কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টারত নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা সচল রাখার স্বার্থে জ্বালানির ‘অযৌক্তিক’ বাড়তি দাম এবং পরিবহন ধর্মঘট দুটোই প্রত্যাহার করা উচিত।
শনিবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি তোলা হয়। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, "লকডাউনসহ নানা কারণে দেশের ৭৭ ভাগ মানুষের আয় কমেছে।মানুষজন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে যখন দিশাহারা, ঠিক তখনই জ্বালানি তেলের দাম একলাফে ২৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।এতে মানুষের যাতায়াত, পণ্য পরিবহন, খাদ্যপণ্য ও কৃষিজ উৎপাদনসহ সামগ্রিক ব্যয় আরও কয়েকগুণ বেড়ে যাবে।এতে নতুন করে আরও কয়েক কোটি মানুষ দারিদ্রের ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।"