অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

তত্ত্বাবধায়ক সরকার: কেন এলো, কীভাবে গেলো, ফেরত আসার সম্ভাবনা আছে কি?


তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের জুন মাসে নির্বাচনে জয়লাভের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলাপ করছেন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সাথে। হাসিনার বাঁ পাশে রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের জুন মাসে নির্বাচনে জয়লাভের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলাপ করছেন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সাথে। হাসিনার বাঁ পাশে রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ।

বাংলাদেশের প্রায় তিন দশকের নির্বাচনকেন্দ্রীক আন্দোলন-সংগ্রাম বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, বিরোধী দলগুলো সবসময় নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সোচ্চার, আর সরকারে থাকা দলগুলো এমন নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার ঘোর বিরোধী।

যে নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ তিন মাসের মধ্যে একুশ দফা হরতাল করেছে, অসহযোগ আন্দোলন করেছে টানা ৩৯ দিন, সেই আওয়ামী লীগের সরকারের হাতেই এই ব্যবস্থার মৃত্যু ঘটেছে।

অন্যদিকে যে সরকার ব্যবস্থা প্রণয়ন ঠেকাতে বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকাকালে বদ্ধপরিকর ছিল, পরবর্তীতে যে ব্যবস্থাকে বিতর্কিত করার দায়ও বহুলাংশে দলটির কাঁধে বর্তায়, সেই বিএনপির এখন অন্যতম দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনা।

এমনকি নিজেদের ওয়েবসাইটে যে একত্রিশ দফার “রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা” বর্ণনা করেছে বিএনপি, সেখানে “নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার” ব্যবস্থা প্রবর্তনের আশ্বাস রয়েছে তিন নম্বর অবস্থানে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা যেখান থেকে

জাতীয় সংসদের আপাত গুরুত্বহীন একটি আসনের উপনির্বাচন কি রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা একটি দলের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে উঠতে পারে?

১৯৯৪ সালের ২০শে মার্চ। ঢাকা থেকে পৌনে দুইশ কিলোমিটার দূরে মাগুরা জেলায় একটি উপনির্বাচন হচ্ছে। ওই সময়ের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বিএনপির আয়োজনে কার্যত শেষ উপ-নির্বাচন ছিল এটি।

এমনিতে যে কোন কারণে আসন শূণ্য হওয়ায় কোন সংসদীয় আসনে অনুষ্ঠিত উপ-নির্বাচনের খুব একটা গুরুত্ব নেই। রাষ্ট্রক্ষমতার রাজনীতিতে এর তেমন কোন প্রভাব পরে না সাধারণত।

কিন্তু মাগুরা-২ আসনের এই উপ-নির্বাচনটি বাংলাদেশের রাজনীতির কেন্দ্রস্থলে দারুণ আলোড়ণ তুলেছে। খোদ বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা, সরকারদলীয় একাধিক মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ ৮০জন ভিআইপি এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মাগুরা সফর করেছেন বলে সেসময়কার পত্রপত্রিকায় খবর।

একুশে মার্চ ১৯৯৪ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত পত্রপত্রিকার প্রধান শিরোনামই এই মাগুরা নির্বাচন।

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার আমলে মাগুরা উপ-নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের পটভূমিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ভোটের দাবি জোরদার হয়। (ফাইল ছবি)
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার আমলে মাগুরা উপ-নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের পটভূমিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ভোটের দাবি জোরদার হয়। (ফাইল ছবি)

এমনকি সরকারের মেয়াদের প্রায় শেষের দিকের এই উপ-নির্বাচনটি নিয়ে খোদ বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা একটি সংবাদ সম্মেলনও করেছেন, যে নির্বাচনে বিজয়ী এমপির মেয়াদ পুরো এক বছরও নয়।

একটি পত্রিকা শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনের বরাত দিয়ে প্রধান শিরোনাম করেছে, “মাগুরা-২ আসনের ফল বাতিল করতে হবে”।

তিন দশক পর এসে আজো বাংলাদেশে নির্বাচনে কারচুপীর উদাহরণ হিসেবে মাগুরার সেই উপ-নির্বাচনের কথা অনেকেই মনে করেন। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পর প্রথাম আলোর এক কলামে কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হোসেন লিখেছিলেন, “এবার ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তো ঘরে ঘরে মাগুরা সৃষ্টি হয়েছে”।

মাগুরার এই নির্বাচনের পর সেসময়কার বিরোধী দল আওয়ামী লীগের একটি আন্দোলন জোর গতি পায়।

এই আন্দোলনকে প্রয়াত সাংবাদিক ও কলামিস্ট মিজানুর রহমান তার ১৯৯৫ সালের এক লেখায় বর্ণনা করেছেন “ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষে একটি ব্যতিক্রমধর্মী প্রবল আন্দোলন”।

তখন সবেমাত্র তিন বছর হয়েছে বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম বড় আন্দোলনকারী জোটের একটি বিএনপি ক্ষমতায়।

কিন্তু তিন বছরেই আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে বিএনপির শাসনাধীনে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন হলে সেটা অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে না।

আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনাঃ খুব দ্রুত তিনি বিএনপির অধীনে নির্বাচনের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন। (ফাইল ছবি)
আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনাঃ খুব দ্রুত তিনি বিএনপির অধীনে নির্বাচনের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন। (ফাইল ছবি)

পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনটি আরো দু বছর পরে। কিন্তু দু বছর বাকী থাকতেই আওয়ামী লীগ সব ধরণের নির্বাচনে অংশ নেয়া বন্ধ করে দিল। এই কাজে দলটি সহযাত্রী হিসেবে পেলে এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টি, ধর্মভিত্তিক দল জামায়াতে ইসলামীসহ আরো কিছু বিরোধী দলকেও।

তারা সরকার-বিরোধী মাঠের আন্দোলনের পাশাপাশি এমন এক ‘ফর্মূলা’ খুঁজছিল, যে ফর্মুলায় নির্বাচন হলে সেটা সত্যিকার অর্থেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে।

অবশেষে তারা পেয়েও যায় সেই ‘ফর্মুলা’।

আজকের দিনে আমরা বাংলাদেশের কেয়ারটেকার সরকার বলে যা জানি, মাগুরা নির্বাচনের তিন মাস পর অনেকটা সেরকম একটি ‘রূপরেখা’ প্রকাশ্যে আনে বিরোধী দলগুলো।

প্রয়াত সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানের বই ‘সংবিধান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিতর্ক’ থেকে জানা যাচ্ছে, ১৯৯৪ সালের ২৭শ মার্চ ঢাকার জাতীয় সংসদ ভবনে আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টি একটি যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে যেখানে এই ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা’ ঘোষণা করে।

অবশ্য জামায়াতের সাথে একযোগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করার বিষয়টি আওয়ামী লীগ বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে।

দু্ই দলের মধ্যে চরম আদর্শিক বিরোধীতা থাকায় এই নিয়ে একটি দীর্ঘস্থায়ী বিতর্কও রয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে।

অনঢ় বিএনপি, মরিয়া আওয়ামী লীগ

বিএনপি এই রূপরেখা পছন্দ করেনি। এই ধারণার বিপক্ষে দলটির নেতারা বিভিন্ন জায়গায় বক্তব্য দিচ্ছিলেন।

এমনকি সেসময়ের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এক বক্তব্যে এও বলেছিলেন যে, “একমাত্র পাগল ও শিশু ছাড়া আর কারো পক্ষে নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব না”।

অন্যদিকে বিরোধী দলগুলো তখন মিছিলে শ্লোগান দেয়, “এই মুহূর্তে দরকার, কেয়ারটেকার সরকার”।

এক পর্যায়ে চুরানবব্বই সালের ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে বিরোধী দল সরকারকে এক মাসের আল্টিমেটাম দেয়।

কিন্তু বিএনপি তাতেও সাড়া না দিলে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের ১৪৭ জন এমপি ডিসেম্বরের ২৮ তারিখ সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন।

তারপরও প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এ নিয়ে সংসদেও কোন আলোচনা করতে আগ্রহ দেখাননি বলে অভিযোগ আছে আওয়ামী লীগের।

বিএনপি সমর্থকরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে এখন আন্দোলন করছে।
বিএনপি সমর্থকরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে এখন আন্দোলন করছে।

আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে দলটির একজন নেতা বিপ্লব বড়ুয়া লিখেছেন, “বিরোধী দল সংসদ থেকে পদত্যাগ করার পরেও ততকালীন সংসদ নেতা বেগম খালেদা জিয়া পঞ্চম জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের আনা প্রস্তাব তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিষয়ে কোনও আলোচনা করতে রাজী হননি”।

বরঞ্চ নব্বই দিন পর ওই আসনগুলোকে শূণ্য দেখিয়ে উপনির্বাচন আয়োজনের উদ্যোগ নেয় নির্বাচন কমিশন।

পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে ওঠে। মাঠের রাজনীতি হয়ে ওঠে সহিংস। বিরোধী দল খালেদা জিয়ার সরকারের অধীনে যে কোন নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়। এক পর্যায়ে উপ-নির্বাচন আয়োজন থেকে সরে আসে নির্বাচন কমিশন।

কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে খালেদা জিয়ার সরকার কোন নমনীয়তা না দেখানোয় আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য বিরোধী দলগুলো ক্রমেই মাঠের আন্দোলন কঠোর থেকে কঠোরতর অবস্থায় নিয়ে যায়।

এসময় বাংলাদেশে হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলন ছিল নিয়মিত ঘটনা।

দৈনিক প্রথম আলোর ২০১৩ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিএনপি আয়োজিত এক তরফা জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট একাশি দিন হরতাল পালন করেছে বিরোধী দল।

এর মধ্যে ছিয়ানব্বই সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসেই হরতাল হয়েছে একুশ বার। আর অসহযোগ আন্দোলনের কারণে দেশ কার্যত অচল ছিল আরো ৩৯ দিন।

বাংলাদেশে নির্বাচনঃ শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারই কি পারে গ্রহণযোগ্য ভোট নিশ্চিত করতে?
বাংলাদেশে নির্বাচনঃ শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারই কি পারে গ্রহণযোগ্য ভোট নিশ্চিত করতে?

সমঝোতার ব্যর্থ চেষ্টা

সংবিধানের ধারাাহিকতা রাখতে হলে ছিয়ানব্বইয়ের বাইশে ফেব্রুয়ারির মধ্যে একটি নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা ছিল। বিএনপি সরকারের অধীনে যে নির্বাচনে না যেতে বদ্ধপরিকর ছিল আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে বিএনপি কোনভাবেই আওয়ামী লীগের রূপরেখা মেনে নিচ্ছিল না।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবিতে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া ও আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার মধ্যে রাজনৈতিক অচলাবস্থা ছিল বাইশ মাস ধরে।

এই বাইশ মাসে একাধিকবার আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার চেষ্টা হলেও কোন পক্ষই নিজ অবস্থান থেকে একচুল নড়তে রাজি হয়নি বলে ১৯৯৬ সালের জানুয়ারি মাসে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এর মধ্যে ১৯৯৪ সালের শেষদিকে বাংলাদেশে দুই পক্ষের সাথে মধ্যস্ততা করতে আসেন কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান স্টেফান। তার উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনের খবর অনুযায়ী, ছিয়ানব্বই সালের গোড়ার দিকেও আরেক দফা সমঝোতার চেষ্টা করেন, জাতিসংঘের দূত ডেভিড এন. মেরিল। কিন্তু তিনিও ব্যর্থ হন।

১৫ই ফ্রেব্রুয়ারির নির্বাচন ও সংবিধান সংশোধন

বিরোধীদের অংশগ্রহণ ছাড়াই সহিংসতাসংকুল বাংলাদেশে ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করে বিএনপি। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি। সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৯টিই বিএনপি পায়।

দেশে এবং বিদেশে কোন গ্রহণযোগ্যতা না পাওয়া এই নির্বাচন নিয়ে বিএনপির যুক্তি ছিল দুটি – প্রথমত সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা। দ্বিতীয়ত আওয়ামী লীগের দাবি অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন পাশের জন্য প্রয়োজনীয় দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন।

আওয়ামী লীগ কখনই, এই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। যদিও এই ষষ্ঠ সংসদেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন পাশ করে বিএনপি, যেটি ছিল আওয়ামী লীগের দেয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখারই প্রতিফলন।

ষষ্ঠ সংসদের অধিবেশন ১৯৯৬ সালের ১৯শে মার্চ শুরু হয়। এই সংসদে একটি আইনই পাশ হয়, যেটি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে যুক্ত করে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী।

মাত্র বার দিন ছিল এই সরকারের মেয়াদ। এই বারো দিনে সংবিধান সংশোধন করে ত্রিশে মার্চ সরকার ভেঙে দেন খালেদা জিয়া।

ওই দিন থেকে ক্ষমতায় আসে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এর আগে যদিও ১৯৯০ সালে এইচ এম এরশাদের সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের শাসনভার কিছুদিন একধরণের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছিল।

কিন্তু বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন ওই সরকার কোন সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল না, যেটি ছিল বিচারপতি হাবিবুর রহমানের সরকার।

বিচারপতি কে এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে পারেন, এই সম্ভাবনার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ২০০৬ সালে আন্দোলন শুরু করে। ফাইল ফটো (২০০৮)
বিচারপতি কে এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে পারেন, এই সম্ভাবনার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ২০০৬ সালে আন্দোলন শুরু করে। ফাইল ফটো (২০০৮)

কেএম হাসানকে নিয়ে আপত্তি

বিচারপতি হাবিবুর রহমানের অধীনে ১৯৯৬ সালের ১২ই জুন একটি জাতীয় নির্বাচন হয়, যেটিতে জিতে ক্ষমতায় আসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সরকার। পরে ২০০১ সালের নির্বাচনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ঠিকঠাক হয়। ওই নির্বাচনে জয় পায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় ঐক্যজোট।

দুটি নির্বাচনই ‘ভাল’ বলে দেশে বিদেশে স্বীকৃতি পেয়েছিল।

প্রয়াত রাজনীতিবিদ ও বিএনপির সিনিয়র নেতা মওদুদ আহমেদ তার বই “সেনা সমর্থিত অন্তর্বতীকালীন সরকার, ২০০৭-২০০৮”-এ লিখেছেন, “…এভাবে দেশে একটি অবাধ ও নির্ভেজাল নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য এই ব্যবস্থাটি জনগণ ও সকল রাজনৈতিক দলের কাছে একটি পরীক্ষিত এবং স্বীকৃত পন্থা হিসেবে গৃহীত হয়”।

কিন্তু গোল বাধে এর পরের নির্বাচনে এসে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার সংবিধানে সংশোধনী আনে, যেটি নিয়ে বিরোধী দলগুলো আপত্তি তোলে।

এই সংশোধনীতে দুটি পরিবর্তন ছিল – একটি হল সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ত্রিশ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ করা। অন্যটি বিচারপতিদের অবসরের সময়সীমা বাড়ানো।

এই অবসরের সময়সীমা বাড়ানোতেই ছিল আওয়ামী লীগের আপত্তি। কারণ আইন অনুযায়ী সর্বশেষ প্রধান বিচারপতি পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হবেন। আর সংশোধনী মোতাবেক কদিন আগে অবসরে যাওয়া সাবেক প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানই হবেন সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি।

কিন্তু বিরোধী দলের বক্তব্য কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার জন্যই সংবিধানে এই পরিবর্তন।

আওয়ামী লীগ এই কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার বিরুদ্ধে। কারণ আওয়ামী লীগের অভিযোগ, কে এম হাসান বিএনপির লোক, যিনি বিএনপি থেকে নির্বাচনও করতে চেয়েছিলেন। এমনকি তিনি বিএনপির কমিটিতেও ছিলেন বলে খবর বের হয়।

আবারো আন্দোলন শুরু হয় আওয়ামী লীগের।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের পর ২০০১ সালের ১০ অক্টোবর আবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের পর ২০০১ সালের ১০ অক্টোবর আবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন।

লগি বৈঠার আন্দোলন

একদিকে আওয়ামী লীগ রাজপথে আন্দোলন করছিল। অন্যদিকে সমাধানের পথ খুঁজতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের সঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মান্নান ভূঁইয়ার ধারাবাহিক সংলাপ চলছিল।

সংলাপ কার্যত ব্যর্থ হয়। আন্দোলন চূড়ান্ত আকার ধারণ করে ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে।

কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়া ঠেকাতে শেখ হাসিনা নেতাকর্মীদের সারা দেশ থেকে লগি-বৈঠা নিয়ে ঢাকায় আসতে আহ্বান জানান। আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠে।

পরে ওই আন্দোলন ‘লগি-বৈঠার আন্দোলন’ বলে পরিচিতি পায়।

অক্টোবরের ২৮ তারিখ ছিল বিএনপি সরকারের শেষ দিন। এদিন থেকে আওয়ামী লীগ রাজপথ অবরোধের ঘোষণা দেয়। সহিংসতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

পরদিন ২৮শে অক্টোবর দৈনিক ইত্তেফাকের শিরোনাম ছিল, “দেশজুড়ে নৈরাজ্য”। আর উপশিরোনাম ছিল “সংঘর্ষ ও গুলিতে নিহত ১১, আহত শত শত। রাজধানী বিচ্ছিন্ন”।

তবে সারা দেশের সংঘর্ষ ও সহিংসতার মধ্যে একটি ঘটনা বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছিল মানুষের মনে। কারণ ওই ঘটনাটির সহিংসতার দৃশ্য মানুষ টেলিভিশনে দেখতে পেয়েছিল।

ঘটনাটি ছিল, ২৮শে অক্টোবর দুপুরে লগিবৈঠা নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা ঢাকার পল্টন ও বায়তুল মোকাররম এলাকার রাজপথ দখল নিতে গিয়ে জামায়াতে ইসলামীর সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পরে। এসময় কয়েকজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

পরে গণমাধ্যমের খবরাখবরে জানা যায়, ওই ঘটনায় যে ৫ জন নিহত হয়েছিল তার মধ্যে ৪ জনই ছিল জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবিরের নেতা-কর্মী।

পরিস্থিতি দেখে বিচারপতি কে এম হাসান এক বিবৃতি দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের অধিবেশন কক্ষ।
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের অধিবেশন কক্ষ।

ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের তত্ত্বাবধায়ক

সংবিধান অনুযায়ী সবশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে অপারগ হলে আরো ছয়টি বিকল্পের কথা বলা আছে। সবশেষ বিকল্পটি হল রাষ্ট্রপতি নিজেই এই দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।

রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ ৩০ শে অক্টোবর অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন।

কিন্তু এসময় প্রশ্ন ওঠে, রাষ্ট্রপতি কি সবশেষ বিকল্পটি বেছে নেয়ার আগে বাকি বিকল্পগুলো খতিয়ে দেখেছিলেন?

চ্যানেল আই অনলাইনের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, “কে এম হাসান আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব নিতে অপারগতা জানালেও পরের দুটি বিকল্প হিসেবে সম্ভাব্য প্রধান উপদেষ্টা সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরী ও বিচারপতি হামিদুল হক আনুষ্ঠানিক অপারগতা জানাননি।“

কে এম হাসানকে প্রধান উপদেষ্টা হওয়া ঠেকাতে পারাকে আওয়ামী লীগ আপাত বিজয় বলে মনে করে লাগাতার অবরোধ প্রত্যাহার করে।

কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিনের কিছু বক্তব্যের কারণে বিরোধী মহলে তার নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এর মধ্যে একটি ছিল, প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ তার সরকারকে ‘রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার’ বলে মন্তব্য করেন।

যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকার শুধু নির্বাচনকালীন সরকার হওয়ার কথা।

আওয়ামী লীগের আরো কিছু দাবি ছিল, যার মধ্যে ছিল ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা, প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এম এ আজিজের পদত্যাগ ইত্যাদি।

কিন্তু দলটির এসব দাবি পূরণ না হওয়ায় আওয়ামী লীগ এই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনেও নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে।

কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিনের অধীনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আওয়ামী লীগের এই দাবিকে গুরুত্ব না দিয়ে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।

প্রেসিডেন্ট ও প্রধান উপদেষ্টা ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের অনেক কর্মকাণ্ড তার উপদেষ্টা পরিষদই পছন্দ করছিলেন না। এক পর্যায়ে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চারজন উপদেষ্টা পদত্যাগ করেন।

আওয়ামী লীগ আবারো লাগাতার আন্দোলনে নেমে পড়ে। বিএনপি ও তার শরিকেরা অবশ্য তখন ২০০৭ সালের নির্বাচনের প্রচারণায় ব্যস্ত।

ওদিকে আওয়ামী লীগসহ বিরোধীরা ঘোষণা দিয়েছে তারা নির্বাচন বর্জন করবে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ২০০৭ সালে আবার দেশের রাজনীতিতে সক্রিয় অংশ নেয়।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ২০০৭ সালে আবার দেশের রাজনীতিতে সক্রিয় অংশ নেয়।

ওয়ান ইলেভেন

বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ২০০৭ সালের এগারোই জানুয়ারি দেশের রাজনীতিতে একটা হস্তক্ষেপ করে। তারা রাষ্ট্রপতিকে চাপ দেয় উপদেষ্টা পরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে জরুরি অবস্থা জারি করতে।

পরে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপেই নতুন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন হয় ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে। ওই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ বাংলাদেশে ‘ওয়ান-ইলেভেন’ নামে পরিচিত।

এই ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে সেনাবাহিনী সরাসরি না থাকলেও সবখানেই তাদের প্রচ্ছন্ন হস্তক্ষেপ ছিল বলে মনে করা হয়। দেশে-বিদেশে ওই সরকার 'সেনা সমর্থিত সরকার' বলে পরিচিতি পায়।

যদিও সংবিধান মোতাবেক এই সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারই ছিল, কিন্তু এই সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রায় সব শর্ত ভঙ্গ করেছিল।

তারা তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়েছিল। তাদেরকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। এমনকি দুটো জাতীয় বাজেটও পেশ করতে হয়েছিল।

সংসদের বদলে এই বাজেট পেশ করা হত, পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ে উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের কামরায়। তিনি একটি টিভি ক্যামেরায় তার বাজেট বক্তৃতা রেকর্ড করতেন। পরে সেটি বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচার করা হত।

এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাদের ভাষায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে নানা ‘সংস্কার’ কর্মসূচী চালায়। এমনকি প্রধান দুই দলের নেত্রী খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে কারারুদ্ধও করা হয়।

প্রায় দুই বছর পর ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে এই সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাংলাদেশে একটি জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করে।

সেই নির্বাচনে জিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।

উচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পথ সুগম করে। (ফাইল ছবি)
উচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পথ সুগম করে। (ফাইল ছবি)

ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল

সেনা সমর্থিত ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারই ছিল বাংলাদেশের শেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেই শেখ হাসিনা এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের উদ্যোগ নেন। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্বলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট।

প্রণয়ণের পনের বছর পর ২০১১ সালের দশই মে সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্বলিত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় দেয় এই বলে এই সংশোধনী “সংবিধানের মূল চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক”।

তবে আদালত এও বলে যে, “শান্তিশৃঙ্খলা ও ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে” পরবর্তী দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে।

তবে সেই সরকারের সাথে বিচার বিভাগকে না জড়ানোর পরামর্শ দেয় আপিল বিভাগ।

আওয়ামী লীগ এই রায়কে স্বাগত জানায়। বিএনপি ও তাদের শরিকেরা এর বিরোধিতা করে।

তবে তাদের আশা ছিল আদালতের পরামর্শ মেনে পরবর্তী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হবে।

কিন্তু নির্বাচনের বছর যতই ঘনিয়ে আসছিলো ততই স্পষ্ট হচ্ছিল যে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আর কোন নির্বাচন করতে রাজি নয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে এবার বিএনপি রাস্তায় আন্দোলন করছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে এবার বিএনপি রাস্তায় আন্দোলন করছে।

যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রস্তুাবের একসময় বিরোধীতা করেছিল বিএনপি, সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে এবার শুরু হয় বিএনপি ও জামায়াতসহ তাদের শরিকদের আন্দোলন।

খোদ বিএনপির সিনিয়র নেতা মওদুদ আহমেদ যেখানে তার ২০২০ সালে প্রকাশিত বই ‘সেনা সমর্থিত অন্তবর্তীকালীন সরকার’-এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ‘সাময়িক, উত্তরণমূলক ও অ্যাডহক’ বলে বর্ণণা করেছেন, দেখা গেল বিএনপি সেই ব্যবস্থাকে দীর্ঘায়ীত করতে চায়।

বিএনপির এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবিতে আন্দোলনও হলো সহিংস। প্রচুর রক্তক্ষয় হয় তাদের দীর্ঘ আন্দোলনে।

পাঁচই জানুয়ারি ও ত্রিশে ডিসেম্বরের নির্বাচন

কিন্তু শেষ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি একটি নির্বাচন আয়োজন করে আওয়ামী লীগ।

যে নির্বাচনে বিএনপি, জামায়াত ও তাদের শরিকেরা অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকে।

নির্বাচনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন পেয়ে সংসদে বিরোধী দল হয় জাতীয় পার্টি।

জাতীয় পার্টি ওই সংসদের বিরোধী দল হলেও তাদের একাধিক এমপি মন্ত্রিসভাতেও ঠাঁই পায়। প্রকৃতপক্ষে ওই সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিটি দল থেকেই মন্ত্রিসভার সদস্য নেয়া হয়েছিল।

প্রায় দুই যুগ পর এই প্রথম সংসদে কোন প্রতিনিধিত্ব নেই বিএনপির। এর পরের নির্বাচনে ২০১৮ সালে বিএনপি অংশ নেয় ঠিকই কিন্তু নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার দাবিতে তারা চাপ অব্যহত রাখে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া ২০১৪ ও ২০১৮ সালের দুটি নির্বাচনেরই নিরপেক্ষতা নিয়েই ব্যাপক প্রশ্ন ওঠে।

বিশেষ করে ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচনকে বিরোধীরা ‘রাতের ভোট’ বলে বর্ণনা করে।

গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন গত অগাস্ট মাসেই তার দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় বলেন, “২০১৪ সালে ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচন হয়েছে, ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে হয়েছে। এমতাবস্থায় আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে জাতি চরম উদ্বেগ ও উতকণ্ঠার মধ্যে রয়েছে”।

দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে কি ভোটারদের মাঝে উৎসাহ-উদ্দিপনা দেখা যাবে? (ফাইল ফটো - ২০২১ সালের ইউপি নির্বাচনের দৃশ্য, মুন্সিগঞ্জ থেকে)।
দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে কি ভোটারদের মাঝে উৎসাহ-উদ্দিপনা দেখা যাবে? (ফাইল ফটো - ২০২১ সালের ইউপি নির্বাচনের দৃশ্য, মুন্সিগঞ্জ থেকে)।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আসন্ন

ড. কামাল হোসেন আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, সেই উদ্বেগ রয়েছে বিএনপি, জামায়াত ও অন্যান্য বিরোধী দলেরও।

২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পর গত এক যুগ ধরে এই সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছে বিএনপি। সেই আন্দোলন এখনও অব্যহত।

আর তুমুল আন্দোলন করে যে ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে বাধ্য করেছিল আওয়ামী লীগ, সরকারে থেকে গত এক যুগ ধরেই তার তুমুল বিরোধীতা করছে তারা এবং সফলভাবে ঠেকিয়ে রেখেছে এখন পর্যন্ত।

যদিও ওয়ান ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কারণে এই সরকার ব্যবস্থার নানা দুর্বলতা বেরিয়ে এসেছিল, কিন্তু এই ব্যবস্থাকে দুর্বল করার জন্য বিএনপিকেই দায়ী করে আওয়ামী লীগ।

বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন এখন জানুয়ারি মাসের সাত তারিখে ভোট গ্রহণ করতে যাচ্ছে। এই নির্বাচনটি হচ্ছে শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতায় রেখেই।

এখন পর্যন্ত বিএনপির অবস্থান তারা শেখ হাসিনার অধীনে এমন কোন নির্বাচনে অংশ নেবে না। সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন যে সাতজন এমপি, তারা ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসেই পদত্যাগ করেছেন।

বাংলাদেশের কোন স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও সংসদের উপনির্বাচনে বিএনপি দলীয়ভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে না বেশ অনেকদিন হল।

গত দুই বছরের বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সংবাদ ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা ও মন্ত্রীরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বারবার উল্লেখ করেছেন, “বাংলাদেশে আর কখনোই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরে আসবে না”।

গত মার্চ মাসে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে “ডেড ইস্যু” বলে অভিহিত করেন।

XS
SM
MD
LG